আসসালামুওালাইকুম, প্রিয় পাঠক আপনারা সবাই কেমন আছেন । আজকে আমরা কিছু গুরুত্বপুর্ন বিষয় নিয়ে আলচনা করবো। আজকে আমরা আলোচনা করবো- অর্থের যোগান নিয়ন্ত্রণ, ঋণ নিয়ন্ত্রণ কি, এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণ নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সমূহ নিয়ে। তাহলে চলুন দেরি না করে জেনে নেই এই বিষয়গুলো সম্পর্কে।
অর্থের যোগান নিয়ন্ত্রণ
সাধারণ অর্থে অর্থের যোগান বলতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকার কর্তৃক ইস্যুকৃত নোট ও মুদ্রার সরবরাহকে বোঝায়। কিন্তু বর্তমানে ব্যাংকসৃষ্ট মুদ্রাকেও এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ব্যাংকদৃষ্ট মুদ্রা বলতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তালিকাভুক্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকসৃষ্ট চেক, ব্যাংক ড্রাফট, ক্রেডিট কার্ড ইত্যাদিকে বোঝানো হয়।
যেকোনো দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থের যোগান নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। প্রয়োজনের তুলনায় নোট ইস্যুর পরিমাণ বেশি হলে মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি হয়। যার ফলে অর্থের মূল্য হ্রাস প্রায় এবং দ্রব্যমূল্যের দাম বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে, প্রয়োজনের তুলনায় নোট ইস্যুর পরিমাণ কম হলে মুদ্রাসংকোচন সৃষ্টি হয়। মুদ্রাসংকোচন হলে অর্থের মূল্য বৃদ্ধি পায় এবং দ্রব্যমূল্যের দাম হ্রাস পায়।
তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণ নিয়ন্ত্রণ কৌশল ও অন্যান্য পন্থা অবলম্বন করে বাজারে অর্থের যোগান নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মুদ্রা সরবরাহকে কাম্যমাত্রায় বজায় রাখতে সক্রিয় ভূমিকা রাখে।
অর্থের যোগান পরিমাপ করার প্রচলিত একটি পদ্ধতি হলো-
Ms = Mo + M + M যেখানে,
Ms = অর্থের যোগান
M = কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঞ্চিত অর্থ
M = জনগণের নিকট রক্ষিত ও বাজারে সঞ্চালিত অর্থ
M = বাণিজ্যিক ব্যাংকের জমাকৃত সঞ্চয়ী ও স্থায়ী আমানত
ঋণ নিয়ন্ত্রণ কি
ঋণ নিয়ন্ত্রণ বলতে ব্যাংকের ঋণ বা আগামকে কাম্যস্তরে রাখাকে বোঝায়। অর্থাৎ দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণের পরিমাণ বা ঋণ সরবরাহ কাম্যস্তরে বজায় রাখার লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক গৃহীত কৌশল হলো ঋণ নিয়ন্ত্রণ।
দেশের সুষ্ঠু ও সুসম অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বাজারে মুদ্রা বা অর্থ সরবরাহের আধিক্য বা স্বপ্নতা উভয়ই ক্ষতিকর। দেশের মুদ্রাস্ফীতির জন্যেই ঋণ নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন এটা যেমনি সত্যি, তেমনি ঋণের স্বল্পতার জন্যেও ঋণ নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন হয় ।
বাজারের অর্থ সরবরাহ হ্রাস-বৃদ্ধি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক মুদ্রার মান তথা ক্রয়ক্ষমতা সংরক্ষণ করার জন্য ঋণ নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন পরে ।কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেসব পদ্ধতি বা কৌশল অবলম্বন করে দেশের ঋণ প্রবাহ কাম্যস্তরে বজায় রাখার ব্যবস্থা করে তার সমন্বিত রূপকে ঋণ নিয়ন্ত্রণ বলা যায়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণ নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সমূহ
ঋণ নিয়ন্ত্রণের অনেকগুলো উদ্দেশ্যের মধ্যে অন্যতম উদ্দেশ্য হলো মুদ্রাস্ফীতি ও মুদ্রাসংকোচনকে কাম্যমাত্রায় বজায় রেখে দ্রব্যমূল্যের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা ।
আর একটি দেশের অর্থনীতির জন্য বেশি মুদ্রাস্ফীতিও যেমন ভালো না আবার মুদ্রাসংকোচনও ভালো না । আর সেইজন্যই ঋণ নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন হয় । তাই বাণিজ্যিক ব্যাংকের পর্যাপ্ত হারে ঋণ সরবরাহ নিশ্চিত করে অর্থবাজারকে স্থিতিশীল করে দ্রব্যমূল্যের স্থিতিশীলতা রক্ষার্থে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণ নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা চালায়। এ লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণ নিয়ন্ত্রণের জন্য কিছু কৌশল প্রয়োগ করে যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণ নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি বা কৌশল বা হাতিয়ার হিসেবে পরিচিত।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণ নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি দুই ভাগে আলোচনা করা যায়- ক. সাধারণ বা সংখ্যাত্মক বা পরিমাণগত পদ্ধতি খ. গুণগত বা নির্বাচনমূলক পদ্ধতি ।
আরও পড়ুন >>> কেন্দ্রীয় ব্যাংক কাকে বলে ?
ক. সাধারণ বা সংখ্যাত্মক বা পরিমাণগত পদ্ধতি
ঋণের উদ্দেশ্য বা ব্যবহারের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি আরোপ না করে সাধারণভাবে বাণিজ্যিক ব্যাংক কর্তৃক প্রদত্ত সকল প্রকার ঋণের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করার পদ্ধতিকে ঋণ নিয়ন্ত্রণের সাধারণ বা সংখ্যাত্মক বা পরিমাণগত পদ্ধতি বলে।
১. ব্যাংক হার নীতি: বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো যে সুদের হারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করে বা প্রথম শ্রেণির সিকিউরিটিজ পুনঃবাট্টাকরণ করে, তাকে ব্যাংক হার বা বাট্টা হার বলে। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে নীতির আলোকে ব্যাংক হার হ্রাস-বৃদ্ধি করে বাণিজ্যিক ব্যাংক প্রদত্ত ঋণ সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে তাকে ব্যাংক হার নীতি বলে। ঋণ সরবরাহ বৃদ্ধির প্রয়োজন হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংক হার হ্রাস করে ফলে সুদের হার হ্রাস পায়। যে কারণে জনগণের মাঝে ঋণ গ্রহণের প্রবণতা বৃদ্ধি পায় এবং বাজারে ঋণ সরবরাহ বাড়ে। অনুরূপভাবে যখন ঋণ সরবরাহ কমানোর প্রয়োজন পড়ে তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংক হার বৃদ্ধি করে ফলে সুদের হার বৃদ্ধি পায়। যে কারণে জনগণের ঋণ গ্রহণের অনাগ্রহ সৃষ্টি হয় এবং বাজারে ঋণ সরবরাহ কমে। এভাবে ব্যাংক হার হ্রাস বা বৃদ্ধির মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে অর্থবাজারকে স্থিতিশীল রাখে।
উল্লেখ্য, ব্যাংক হার নীতি তখনই কার্যকর হবে, যখন
(ক) তালিকাভুক্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আদেশ-নির্দেশ মেনে চলে,
(খ) দেশের মুদ্রাবাজার বা অর্থবাজার সুসংগঠিত হয়।
২. খোলাবাজার নীতি: যে বাজার থেকে জনগণ অবাধে সিকিউরিটিজ ক্রয়-বিক্রয় করতে পারে তাকে খোলাবাজার বলে। আর যে নীতির আলোকে বাজারে অর্থ বা ঋণ সরবরাহ হ্রাস বা বৃদ্ধির কৌশল হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক খোলাবাজারে বিভিন্ন ধরনের সিকিউরিটিজ ক্রয়-বিক্রয় করে তাকে খোলাবাজার নীতি বলে ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক খোলাবাজারে বিভিন্ন ধরনের সরকারি সিকিউরিটিজ যেমন : ঋণপত্র, বন্ড ইত্যাদি বিক্রি করতে পারে আবার বেসরকারি বন্ড, শেয়ার ইত্যাদি ক্রয়ও করতে পারে । মূলত ঋণ নিয়ন্ত্রণে খোলাবাজার নীতি কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরোক্ষভাবে বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণদান ক্ষমতা হ্রাস-বৃদ্ধি করে বাজারে ঋণ সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে।
ঋণ সরবরাহ বৃদ্ধির প্রয়োজন হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক খোলাবাজার থেকে বিভিন্ন ধরনের বন্ড বা সিকিউরিটিজ উচ্চ সুদের হারে ক্রয় করবে। তখন অধিক লাভের আশায় জনগণ। তাদের ধারণকৃত সিকিউরিটিজ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিকট বিক্রয় করে নগদ টাকা সংগ্রহ করে আমানত হিসেবে বাণিজ্যিক ব্যাংকে জমা রাখবে, ফলে বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণদান ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে এবং বাজারে অর্থ বা ঋণ সরবরাহ বৃদ্ধি পাবে।
অনুরূপভাবে যখন ঋণ সরবরাহ কমানোর প্রয়োজন পড়ে তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক খোলাবাজারে বিভিন্ন ধরনের বন্ড বা সিকিউরিটিজ বিক্রয় করবে। অধিক সুদ পাওয়ার আশায় বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে জমাকৃত অর্থ উত্তোলন করে জনগণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিকিউরিটিজ ক্রয় করবে। এক্ষেত্রে বাণিজ্যিক ব্যাংকের আমানতকৃত তহবিল হ্রাস পাবে। ফলে ঋণদান ক্ষমতাও হ্রাস পাবে এবং বাজারে অর্থ বা ঋণ সরবরাহ হ্রাস পাবে।
৩. জমার হার পরিবর্তন নীতি : প্রচলিত আইন অনুযায়ী প্রত্যেক দেশের তালিকাভুক্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে গ্রাহকদের থেকে সংগৃহীত আমানতের একটা নির্দিষ্ট অংশ নগদে ও অংশবিশেষ বন্ড বা সিকিউরিটিজ ক্রয় করে বাধ্যতামূলকভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিকট জমা রাখতে হয়। আমানতের কত শতাংশ জমা রাখতে হবে তা কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্ধারণ করে দেয়। প্রয়োজনে উক্ত জমার হার হ্রাস-বৃদ্ধি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক ঋণ নিয়ন্ত্রণ করার কৌশলকে জমার হার পরিবর্তন নীতি বলে। বাজারে ঋণ সরবরাহ বৃদ্ধির প্রয়োজন হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জমার হার হ্রাস করে ফলে বাণিজ্যিক ব্যাংকের নগদ অর্থের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় এবং ঋণদান ক্ষমতা বাড়ে। এক্ষেত্রে বাজারে ঋণ সরবরাহ বাড়ে। অনুরূপভাবে বাজারে ঋণ সরবরাহ কমানোর প্রয়োজন হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জমার হার বৃদ্ধি করে ফলে বাণিজ্যিক ব্যাংকের নগদ অর্থের পরিমাণ হ্রাস পায় এবং ঋণদান ক্ষমতা হ্রাস পায়।
বাণিজ্যিক ব্যাংক নগদে যে অর্থ জমা রাখে তাকে নগদ জমার হার (Cash Reserve Requirement/ CRR) বলে। এছাড়া অবশিষ্ট অংশ ট্রেজারি বিল বা সিকিউরিটিজ ক্রয় করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সংরক্ষণ করতে হয়, তাকে বিধিবদ্ধ সন্নিতির হার (Statutory Liquidity Ratio/SLR) বলে।
ঋণ নিয়ন্ত্রণের অত্যন্ত কার্যকর কৌশল হিসেবে জমার হার পরিবর্তন নীতি বহুল প্রচলিত ও জনপ্রিয় একটি পদ্ধতি। কেননা এটি অনেকটা প্রত্যক্ষ ও বাধ্যতামূলক ঋণ নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি।
খ. গুণগত বা নির্বাচনমূলক পদ্ধতি:
ঋণের উদ্দেশ্য বা ব্যবহারের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি আরোপ করে বাণিজ্যিক ব্যাংক কর্তৃক প্রদত্ত সকল প্রকার ঋণের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করার পদ্ধতিকে ঋণ নিয়ন্ত্রণের গুণগত বা নির্বাচনমূলক পদ্ধতি বলে। নিচে ঋণ নিয়ন্ত্রণের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নির্বাচনমূলক পদ্ধতি আলোচনা করছি-
১. ঋণের বরাদ্দকরণ নীতি (Rationing of credit) : বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ইচ্ছেমতো কোনো খাতে অধিক ঋণ আবার কোনো খাতে কম ঋণ প্রদান করে অধিক মুনাফা অর্জনের প্রচেষ্টা চালাতে পারে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রদত্ত নির্দিষ্ট নীতিমালা অনুসরণ করে কেবল নির্বাচিত ও নির্দেশিত খাতে বাণিজ্যিক ব্যাংক ঋণ প্রদান করে থাকে। এক্ষেত্রে বিশেষ খাত চিহ্নিত করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো খাতে অধিক ঋণ প্রদানে উৎসাহিত করে আবার কোনো খাতে ঋণ প্রদানে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ওপর কড়াকড়ি আরোপ করে। যেমন: গৃহনির্মাণ ও শিল্প-কারখানা স্থাপনের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণের বরাদ্দ বাড়াতে পারে। এক্ষেত্রে উক্ত খাতে ঋণের প্রবাহ বাড়বে। অন্যদিকে, অটোমোবাইল ব্যবসায় খাতে আমদানি বৃদ্ধি পেলে উক্ত খাতে ঋণের বরাদ্দ কমাতে পারে। ফলে ঋণের প্রবাহ কমবে। এভাবে নির্দিষ্ট খাতে ঋণের বরাদ্দ হ্রাস-বৃদ্ধি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক ঋণ নিয়ন্ত্রণ করার পদ্ধতিকে ঋণের বরাদ্দকরণ নীতি বলে।
২. ভোক্তা ঋণ নিয়ন্ত্রণ (Consumer’s credit control) : সাধারণত ব্যক্তিগত বা গৃহস্থালি ব্যবহারের জন্য যে ঋণ নেওয়া হয় তাকে ভোক্তা বা কনজুমার ঋণ বলে। যেমন টিভি, ফ্রিজ, গাড়ি, ফ্ল্যাট ক্রয় বাবদ ঋণ এক ধরনের ভোক্তা ঋণ। কিস্তিতে পরিশোধ্য বিধায় বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ ধরনের ক্ষণ খুবই জনপ্রিয়। যখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করে ভোক্তা ঋণের পরিমাণ কমানো দরকার তখন কিস্তির সংখ্যা কমিয়ে দেয় ফলে কিস্তির পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় ভোক্তা ঋণ গ্রহণে গ্রাহক নিরুৎসাহিত হয় আবার ঋণের প্রবাহ বাড়ানোর প্রয়োজন হলে ঋণের কিস্তির সংখ্যা বাড়িয়ে দেয় ফলে কিস্তির পরিমাণ হ্রাস পাওয়ায় ভোক্তা ঋণ গ্রহণে গ্রাহক উৎসাহিত হয়। অনেক সময় দ্রব্য বা সম্পদের ক্রয়মূল্যের ওপর ঋণের হার হ্রাস-বৃদ্ধি করে ভোক্তা ঋণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়। যেমন: সিটি ব্যাংক গাড়ির রুমূল্যের ৫০% ঋণ প্রদান করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি ক্রয়মূল্যের ওপর ৪০% ঋণ প্রদানের নির্দেশ দেয় সেক্ষেত্রে ভোক্তা ঋণের প্রবাহ হ্রাস পাবে।
৩. জামানতি ঋণের প্রান্তিক হার পরিবর্তন (Change in the marginal rate of security credit): সম্পত্তি বন্ধক রেখে ব্যাংক থেকে যে ঋণ নেওয়া হয় তাকে জামানত ঋণ বলা হয়। সাধারণত যত টাকার সম্পত্তি। জামানত রাখা হয় ব্যাংক তত টাকা ঋণ প্রদান করে না। একটি অংশ ঋণ মার্জিন রেখে বাকি অংশ ব্যাংক ঋণ হিসেবে প্রদান করে থাকে। এক্ষেত্রে ঋণ মার্জিনের হার হ্রাস-বৃদ্ধি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ২৫% ঋণ মার্জিন রাখার অর্থ হলো ১০০ টাকার সম্পদের বিপরীতে ৭৫ টাকা ঋণ প্রদান করা। এক্ষেত্রে ঋণ মার্জিন ৩৫% হলে ঋণের প্রবাহ ৭৫ টাকা থেকে কমে ৬৫ টাকা হবে। অর্থাৎ বাজারে ঋণের পরিমাণ হ্রাস পাবে। এভাবে জামানতি ঋণের প্রান্তিক হার হ্রাস-বৃদ্ধি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
৪. প্রত্যক্ষ ব্যবস্থা গ্রহণ (Direct action) : কেন্দ্রীয় ব্যাংক ক্ষেত্রবিশেষ প্রত্যক্ষ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমেও ঋণ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যাবতীয় নিয়ম-নীতি ও নির্দেশনা বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো মানতে বাধ্য থাকে। যদি কোনো ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি ও নির্দেশনা অমান্য করে নিজের সুবিধামতো ঋণদান করে তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক উক্ত ব্যাংকের ওপর প্রত্যক্ষ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা প্রয়োগের মাধ্যমে ঋণ নিয়ন্ত্রণ করে। প্রত্যক্ষ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেসকল কৌশল প্রয়োগ করে তা হলো-
ক. অতিরিক্ত রিজার্ভ সংরক্ষণের নির্দেশ;
খ. বিল পুন:বাট্টাকরণে অস্বীকৃতি;
গ. ঋণ সুবিধা প্রত্যাহার,
ঘ. নিকাশ ঘর সুবিধা প্রত্যাহার:
ঙ. নগদ অর্থ জরিমানা প্রভৃতি ।
৫. নৈতিক প্ররোচনা : কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনেক সময় তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোকে বিভিন্নভাবে উপদেশ ও পরামর্শ প্রদানের মাধ্যমে নৈতিকভাবে প্রভাবিত ও প্ররোচিত করে ঋণ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। ব্যাংকের ভাষায় একে নৈতিক প্ররোচনা পদ্ধতিতে ঋণ নিয়ন্ত্রণ বলে। যেমন : দেশে নতুন তরুণ উদ্যোক্তা সৃষ্টির লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তরুণ উদ্যোক্তাদের সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের পরামর্শ প্রদান করতে পারে। এতে ঋণের প্রবাহ বৃদ্ধি পাবে। অন্যদিকে দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বা অন্যকোনো কারণে পোশাক শিল্পে ঋণখেলাপি বৃদ্ধি পেলে নতুন করে ঋণ না দেওয়ার ব্যাপারে উপদেশ ও পরামর্শ প্রদান করে ঋণের প্রবাহ কমাতে পারে ।
৬. প্রচারণামূলক পদ্ধতি: কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন প্রকার পত্রপত্রিকা, প্রতিবেদন, ম্যাগাজিন, বুলেটিন প্রভৃতির মাধ্যমে দেশের আর্থিক অবস্থা, মুদ্রা নীতি, ব্যাংকিং পরিস্থিতি, মুদ্রাবাজারের অবস্থা ইত্যাদি বিষয়ে জনগণ ও দেশে পরিচালিত সকল প্রতিষ্ঠানকে অবগত ও সচেতন করে থাকে। এ পদ্ধতিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রচারণামূলক পদ্ধতি বলে।
একটি দেশের অর্থনীতিতে মন্দাভাব দূর করতে এবং বাজারে ঋণের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মূল্যস্তর স্থিতিশীল রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণ নিয়ন্ত্রণ কৌশলসমূহ অত্যন্ত কার্যকর । বাজার পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন সময়ে এক বা একাধিক ঋণ নিয়ন্ত্রণ কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে ।