অর্থ বলতে এমন বস্তুকে বোঝায় যা বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে, মূল্যের পরিমাপক ও সঞ্চয়ের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। এক্ষেত্রে অর্থ বলতে নগদ অর্থকেই বোঝানো হয়ে থাকে । আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অর্থের প্রয়োজনীয়তা ব্যাপক । অর্থ ছাড়া কোনো ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান বা অব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করা সম্ভব নয় । ব্যবসায়িক পরিভাষায় অর্থ বলতে নগদ অর্থ ছাড়াও অর্থাকারে প্রকাশিত যেমন- চেক, শেয়ার, বন্ড, কণপত্র, প্রাপ্য বিল প্রাইজবন্ড ইত্যাদি আরও অনেক বিষয়কেও বোঝানো হয়ে থাকে । অর্থায়নকে অর্থ ব্যবস্থাপনার কলা ও বিজ্ঞান বলা হয় । তাহলে চলুন জেনে নেই অর্থায়ন কি বা কাকে বলে, অর্থায়নের ধরণ ও এর কার্যাবলি ।
অর্থায়ন কি বা অর্থায়ন কাকে বলে
অর্থায়নের ধারণা : ল্যাটিন শব্দ ‘finis’ থেকে ইংরেজি ‘finance’ শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে, যার বাংলা অর্থ – অর্থায়ন বা অর্থসংস্থান। প্রথমে অর্থায়নকে মূলত অর্থ বা তহবিল সংগ্রহ (raising of fund) হিসেবে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু বর্তমানে তথ্য প্রযুক্তির যুগে অর্থায়নের আওতা বা পরিধি অনেক বিস্তৃত ও গতিশীল। অর্থায়ন মূলত ব্যবসায় অর্থায়নকেই বেশি বোঝানো হয়ে থাকে ।
বিশদভাবে আলোচনা করলে- কোন উৎস থেকে কী পরিমাণ তহবিল সংগ্রহ করা যাবে, কোথায় কীভাবে সেই তহবিল বিনিয়োগ করা হলে কারবারের সর্বোচ্চ মুনাফা হবে, অর্থায়ন সেই সংক্রান্ত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করে করে থাকে । একটি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে মালামাল বিক্রয় থেকে অর্থের আগমন হয়। আবার ব্যবসায়ে পণ্য প্রস্তুত ও ক্রয় করার জন্য বিভিন্ন ধরনের তহবিলের প্রয়োজন হয়। যেমন- মেশিনারিজ ক্রয়, কাঁচামাল ক্রয় ইত্যাদি। তাই প্রয়োজন অনুযায়ী পরিকল্পনামাফিক তহবিল সংগ্রহ করতে হয়, যেন উৎপাদন প্রক্রিয়া চলমান থাকে। অর্থায়ন বলতে তহবিল সংগ্রহ ও এর ব্যবহারসংক্রান্ত প্রক্রিয়াকে বোঝানো হয়ে থাকে । তাই অর্থায়নকে ব্যবসায়ের মূল চালিকাশক্তি বলা হয়।
তাই আমরা OL.J. Gitman-এর মতো বলতে পারি “Finance is the art and science of managing money.” অর্থাৎ অর্থ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত কলাকৌশল ও বিজ্ঞানকে অর্থায়ন বলে ।
এতক্ষণ আমরা পড়লাম অর্থায়ন কাকে বলে ? এই আলোচনা বিশ্লেষণ করলে আমরা অর্থায়নের কিছু বৈশিষ্ট্য দেখতে পাই :
- অর্থায়ন বলতে তহবিল সংগ্রহ ও এর ব্যবহারসংক্রান্ত প্রক্রিয়াকে বোঝায়
- অর্থায়ন মূলত কারবারি অর্থায়ন নিয়ে বিশদ আলোচনা করে
- অর্থায়ন অর্থের প্রবাহকে সুচারুভাবে নিয়ন্ত্রণ করে
- অর্থায়নকে ব্যবসায়ের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে ব্যবহার করা হয়
- অর্থায়ন প্রক্রিয়া একজন ব্যবসায়ীকে তহবিল সংগ্রহের সঠিক উৎস নির্বাচনে সাহায্য করে
- তহবিল বিনিয়োগের সঠিক ক্ষেত্র নির্বাচনেও অর্থায়ন সহায়তা করে
অর্থায়নের স্বরূপ/ ধরন / প্রকার (Nature of Finance)
বর্তমান তথ্য প্রযুক্তির যুগে ব্যবসায় এর পরিধি যেমন বেড়েছে তেমন ব্যবসায়ের অর্থসংস্থানও জটিল ও বিস্তৃতি লাভ করছে । ব্যবসায়ের জন্য অর্থ সংগ্রহ করা একটা দুরহ কাজ । এবং সেটি সঠিকভাবে ব্যবহার করতে না পারলে ব্যবসায়ের মূল উদ্দেশ্য অর্জন করা কঠিন হয়ে পরবে । তাই অর্থায়নের পরিধিও অনেক বড় । চলুন জেনে নেই অর্থায়নের স্বরুপ বা ধরনগুলো –
১. পারিবারিক অর্থায়ন
জীবন নির্বাহ করার জন্য অর্থের প্রয়োজন । আমাদের অসীম চাহিদা পুরন করতে হলে অর্থের গুরুত্ব অপরিসীম । পারিবারিক অর্থায়ন বলতে পরিবারের অর্থসংস্থান ও তা ব্যবহার সম্পর্কে নির্দেশ করে। পরিবারের আয়ের উৎস ও পরিমাণ নির্ধারণ করে সেই আয় কীভাবে কোথায় ব্যবহার করলে পরিবারের সদস্যদের মঙ্গল হয়, তা নির্ধারণ করা পারিবারিক অর্থায়নের কাজ । পরিবারের প্রয়োজনীয় অসংখ্য ব্যয়ের মধ্যে কোন ব্যয়টি আগে পুরন করা দরকার তা চিহ্নিত করা, আয়ের তুলনায় ব্যয় যেন বেশি না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা, খুব প্রয়োজন হলে পরিচিত ব্যক্তি, বন্ধু বান্ধবের কাছ থেকে ঋণ নেওয়া এসকল কার্যক্রমই পারিবারিক অর্থায়নের ভিতর পরে ।
২. সরকারি অর্থায়ন
সরকার পরিচালনা করতে হলে অনেক ব্যয়ের প্রয়োজন হয় । সরকার তার বার্ষিক ব্যয় কোন খাতে কী পরিমাণ হবে এবং সেই অর্থ কোন খাত থেকে সংগ্রহ করা যাবে, তা সরকারি অর্থায়নে আলোচনা করা হয়। সাধারণত প্রতিরক্ষা, অবকাঠামোগত যেমন— রাস্তাঘাট, পানি, বিদ্যুৎ, বাঁধ নির্মাণ, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইত্যাদি সহ বিভিন্ন উন্নয়ন কাজ, সরকারি কর্মচারিদের বেতন প্রভৃতি খাতে সরকার অর্থ ব্যয় করে থাকে । আর এই সকল ব্যয় মিটানোর জন্য সরকার বিভিন্ন ধরনের কর, শুষ্ক, সঞ্চয়পত্র, প্রাইজবন্ড প্রভৃতি থেকে অর্থ সংগ্রহ করে থাকে । সরকারি অর্থায়ন আর বেসরকারি বা ব্যবসায়িক অর্থায়ন দুইটাই আলাদা প্রকৃতির ।
৩. আন্তর্জাতিক অর্থায়ন
আন্তর্জাতিক অর্থায়নের মূল উপাদান আমদানি-রপ্তানি । বাংলাদেশ প্রধানত আমদানিনির্ভর দেশ । প্রতিবছর বিপুল পরিমাণে খাদ্যসামগ্রী, কাঁচামাল, মেশিনারিজ, ওষুধ, পেট্রোলিয়াম ইত্যাদি বিভিন্ন দেশ হতে আমদানি করা হয় । অপরপক্ষে, বাংলাদেশ হতে পাট ও পাটজাত দ্রব্য, তৈরি পোশাক, কৃষিজাত দ্রব্য ইত্যাদি রপ্তানি করা হয় । রপ্তানি থেকে আমদানি বেশি হয় বলে প্রতিবছর বিরাট অঙ্কের বাণিজ্য ঘাটতি দেখা যায় । আর এ ঘাটতি পূরণে প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো অর্থ বা রেমিটেন্স বিশেষ ভূমিকা রাখে । আন্তর্জাতিক অর্থায়নে আমদানি ও রপ্তানির খাতসমূহ নিয়ে বিচার বিশ্লেষণ করা হয় এবং এ সংক্রান্ত ঘাটতি কীভাবে মেটানো যায় তা নিয়েই এখানে কাজ করা হয়।
৪. ব্যবসায় অর্থায়ন
অর্থায়নের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধরন হচ্ছে ব্যবসায় অর্থায়ন। মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান তহবিল সংগ্রহ করে এবং তা বিনিয়োগ করে থাকে । যে প্রক্রিয়া ব্যবহার করে এই অর্থ সংগ্রহ করা হয়ে থাকে তাকে ব্যবসায় অর্থায়ন বলে । ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে অর্থায়নের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো বিনিয়োগের জন্য তহবিল সংগ্রহ করা ও তহবিলের সঠিক ব্যবস্থাপনা করা । এক্ষেত্রে একমালিকানা ও অংশীদারি প্রতিষ্ঠানের অর্থায়নের উৎস একই হলেও যৌথমূলধনী কোম্পানির ক্ষেত্রে তার ভিন্নতা রয়েছে।
৫. অব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের অর্থায়ন
মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে পরিচালিত না হয়ে সেবা প্রদানের উদ্দেশ্যে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানকে অব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান বলে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, এতিমখানা, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি প্রভৃতি। এক্ষেত্রে অব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের অর্থ ও অর্থের সমতুল্য সম্পদ সংগ্রহের উৎস চিহ্নিতকরণ এবং তার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের সেবামূলক উদ্দেশ্যকে সফল করতে অব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের অর্থায়ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান সাধারণত অনুদান এবং চাঁদা সংগ্রহের মাধ্যমে বড় অঙ্কের তহবিলের যোগান দেয়।
অর্থায়নের কার্যাবলী আলোচনা কর
নিচে অর্থায়নের কাজ আলোচনা করা হলো :
১. আর্থিক পরিকল্পনা করা : অর্থায়নের প্রথম কাজ হলো আর্থিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করা। কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য অর্জনে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা সরকারের অর্থের প্রয়োজন । আর সেই অর্থ কোথায় থেকে সংগ্রহ করতে হবে তার পরিকল্পনা করতে হয় । আর্থিক পরিকল্পনার সময় অর্থের প্রয়োজনীয়তা এবং অর্থের পরিমাণ, সময় ও অন্যান্য বিষয় বিবেচনা করতে হয়। কী পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন, কত সময়ের জন্য প্রয়োজন, কোন কোন খাতে কী পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন এবং সেই অর্থ কোথায় ব্যয় করা হবে তার একটি বিস্তারিত বিবরণকেই আর্থিক পরিকল্পনা বলা হয়।
২. উৎস শনাক্তকরণ : আর্থিক পরিকল্পনা করার পর অর্থায়নের অন্যতম কাজ প্রয়োজনীয় অর্থ কোন কোন উৎস থেকে পাওয়া যেতে পারে তা চিহ্নিত করা । এটা হতে পারে কোনো ব্যক্তি, বন্ধুবান্ধব বা কোনো আত্মীয়স্বজন, কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে বা অন্য কোনো বাহ্যিক উৎস থেকে। অর্থাৎ প্রয়োজনীয় অর্থ পাওয়া যাবে এমন সম্ভাব্য উৎসসমূহ শনাক্ত করা অর্থায়নের কাজ।
৩. তহবিল সংগ্রহ : শনাক্তকৃত উৎস হতে প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করা অর্থায়নের তৃতীয় কাজ। তহবিল সংগ্রহের ক্ষেত্রে বিভিন্ন নিয়ম-নীতি, শর্ত ও সময় বিবেচনা করতে হয়। এই সব নিয়ন-কানুন ও শর্ত বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় অর্থ এক বা একাধিক উৎস হতে সংগ্রহ করা অর্থায়নের কাজ।
৪. মূলধন বাজেটিং সিদ্ধান্ত : কোম্পানির কোন একটি বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে, সেই বিনিয়োগ কোম্পানির জন্য কতটা ভালো ফলাফল আনবে তা নির্ধারন করে সিদ্ধান্ত নেওয়াকে মূলধন বাজেটিং সিদ্ধান্ত বলে । কোম্পানির দীর্ঘমেয়াদি উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে মূলধন বাজেটিং সিদ্ধান্ত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটি কোম্পানির মুনাফা এবং প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানকে প্রভাবিত করে। মূলধন বাজেটিং-এ যেহেতু কোম্পানির দীর্ঘমেয়াদি সম্পত্তি জড়িত, যাতে বিরাট অংকের আর্থিক বিনিয়োগ সম্পৃক্ত, সেহেতু এর তাৎপর্য অন্যান্য স্বল্পমেয়াদি বিনিয়োগ সিদ্ধান্তের চেয়ে অনেক বেশি। বস্তুত মূলধন বিনিয়োগের সঠিক সিদ্ধান্তের ওপর কোম্পানির ভবিষ্যৎ উন্নয়ন নির্ভরশীল। এ জন্যই প্রকল্প নির্বাচনকালে আর্থিক ব্যবস্থাপককে সর্বাধিক সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়।
৫. স্বল্পমেয়াদি সম্পদ ব্যবস্থাপনা : স্বল্পমেয়াদি সম্পদের দক্ষ ব্যবস্থাপনা ও ব্যবহারের মাধ্যমে আর্থিক ব্যবস্থাপনার সঠিক প্রয়োগ করা হয়। সাধারণত ১ বছর বা তার কম সময়ের বিনিয়োগকে স্বল্পমেয়াদি বা চলতি মূলধন ব্যবস্থাপনা বলে। বেশি অর্থ বিনিয়োগ করলে তারল্য ঘাটতি দেখা দিতে পারে, অনুরূপভাবে কম অর্থ বিনিয়োগ করলে মুনাফা কমে যেতে পারে। এ জন্য লভ্যাংশ ক্ষমতা এবং তারল্যের মধ্যে সামন্তস্য রেখে বিনিয়োগ করা উচিত।
৬. তহবিল বণ্টন / লভ্যাংশ সিদ্ধান্ত : ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান তহবিল সংগ্রহ করে বিভিন্ন লাভজনক খাতে বিনিয়োগ করে মুনাফা অর্জন করে থাকে । এক্ষেত্রে মালিকপক্ষ বা শেয়ারহোল্ডার এবং ঋণদাতাদের প্রত্যাশা পূরণে আর্থিক ব্যবস্থাপককে তহবিল বণ্টনে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে হয়। যেমন শেয়ার বিক্রয়ের মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহ করা হলে কোম্পানির অর্জিত লাভ বা মুনাফা শেয়ার মালিকদের মধ্যে বণ্টন করতে হয়। আবার ব্যাংক ঋণ ও অন্যান্য ঋণ যেমন- বন্ড, ডিবেঞ্চার ইত্যাদির মাধ্যমে তহবিল সংগৃহীত হলে যথাসময়ে নির্দিষ্ট হারে ঋণের সুদ পরিশোধ করতে হয়। এছাড়াও কোম্পানির মুনাফা হতে সরকারকে কর প্রদান করতে হয় ।
আরও পড়ুন >>> ফিন্যান্স ও ব্যাংকিং কাকে বলে ?