পৌরনীতি ও সুশাসনের তাত্ত্বিক বিষয়গুলোর মধ্যে সাম্য (Equality) অন্যতম। তাই আজকে আমাদের আলোচ্য বিষয় সাম্য কি / সাম্য কাকে বলে ? প্রাচীনকালের গ্রিক দার্শনিকগণ থেকে শুরু করে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানিগণ পর্যন্ত সকলেই সাম্যের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন।মূলত সাম্য বলতে সমাজে সকলের জন্য সমান সুযোগ- সুবিধাকে বোঝায়, যেখানে কোনো বিশেষ ব্যক্তি বা বিশেষ কোনো মহলের জন্য বিশেষ ধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকবে না। তাহলে চলুন এখন জেনে নেওয়া যাক সাম্য কি বা সাম্য কাকে বলে ?
সাম্য কি ?
জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী ও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমাজের সকল মানুষের সমান সুযোগ-সুবিধা, অধিকার ও স্বাধীনতা ভোগ করাকে বোঝায়। পৌরনীতিতে সাম্যের অর্থ হচ্ছে, সুযোগ- সুবিধার সমতা (Equality of Opportunities)।
অধ্যাপক লাস্কি (Laski) সাম্য কি ? সে সম্পর্কে বলেন, “সাম্য বলতে সকলের জন্য উপযুক্ত সুযোগ-সুবিধার দ্বার উন্মুক্ত করে দেওয়াকে বোঝায়?” (Equality means that adequate opportunities are laid open to all.)
অধ্যাপক বার্কার (Barker) বলেছেন, “সাম্য কথাটির অর্থ সুযোগ-সুবিধা বা অধিকার বন্টনের ক্ষেত্রে কোনো প্রকার পার্থক্য না করা। ফলে প্রত্যেকের ব্যক্তিত্ব সমানভাবে বিকশিত হবে।”
আান স্টুয়ার্ট মিল (John Stuart Mill)- সাম্য সম্পর্কে কি বলেছেন তা জেনে নেওয়া যাক, “সবার জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা প্রদানই হলো সাম্য।” (Equality means adequate opportunities are to be given open to all.
এক কথায় সাম্য কি তা বলতে গেলে – সাম্য হলো সবার জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করার প্রক্রিয়া ।
সাম্য কথাটি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে তিনটি বিশিষ্টার্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যথা।
প্রথমত, সাম্য বলতে সমতা ভিত্তিক ব্যবস্থাকে বোঝায়। অর্থাৎ সমাজে সকলের অবস্থান সমান। কেউ এমন অবস্থানে আসীন হবে না যার কারণে অন্যের অস্তিত্বই বিলীন হয়ে যায়।
দ্বিতীয়ত, সাম্য বলতে বিশেষ সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থার অনুপস্থিতিকে নির্দেশ করে। অধ্যাপক এইচ, জে, লাস্কি (Prof. I. 1. Laski) বলেন, “Equality means first of all the absence of special privilege.” প্রচলিত সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সুযোগ-সুবিধা যাতে প্রত্যেকের জন্য সমান হয়, কেউ যেন বিশেষ কোনো প্রভাবের কারণে বেশি সুযোগ-সুবিধা লাভ করতে না পারে।
তৃতীয়ত, সকলের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার যাবস্থা করা। রাষ্ট্র কেবল সকলের জন্য সমান সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করবে যাতে প্রত্যেকের ব্যক্তিত্ব বিকাশের সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি হয়। (সাম্য হলো সমতা বিধানের প্রক্রিয়া)
আধুনিক গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় সাম্য বলতে –
- নারী-পুরুষের ভোটাধিকার,
- প্রয়োজনীয় যোগ্যতানুযায়ী চাকরি লাভের অধিকার,
- রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ক্ষমতা লাভের অধিকারকে বোকায়।
তাই সাম্য কি তা বলতে গেলে আমাদের বলতে হবে, সাম্য মানবজীবনের সেই পরিবেশ বা প্রক্রিয়াকে যোঝানো হয়, যেখানে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হয়, সুষম পরিবেশ গড়ে তোলা হয় এবং সবাইকে সমানভাবে ব্যক্তিত্ব বিকাশের সুযোগ প্রদান করা হয়।
আরও পড়ুন>>> মূল্যবোধ কি বা কাকে বলে ? মূল্যবোধের বৈশিষ্ট্য ও শ্রেণিবিভাগ !
সাম্যের শ্রেণিবিভাগ (Classification of equality)
ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের বিকাশের জন্য সাম্য অপরিহার্য। কারণ সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে সাম্যাবস্থা বিরাজ করলে মানুষ সে সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করে তার আত্মবিকাশ ঘটাতে পারে। সাম্যের প্রকারভেদ সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতানৈক্য বিদ্যমান। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা নিম্নোক্ত সাত প্রকার সাম্যের কথা বলেছেন। নিম্নে সাম্যের প্রকারভেদ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-
১। সামাজিক সাম্য
২। রাজনৈতিক সাম্য
৩। অর্থনৈতিক সাম্য
৪। আইনগত সাম্য
৫। স্বাভাবিক সাম্য
৬। নাগরিক সাম্য বা ব্যক্তিগত সাম্য
৭। শিক্ষা ও সংস্কৃতিক সাম্য
১. সামাজিক সাম্য (Social equality)
সামাজিক সাম্য বলতে বোঝায় সমাজের দৃষ্টিতে মানুষের সংঙ্গে মানুষের সমতা। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, বংশ-মর্যাদা, প্রভাব-প্রতিপত্তি নির্বিশেষে যখন কোনো মানুষের সাথে কোনো মানুষের পার্থক্য নিরূপণ করা হয় না তখন তাকে সামাজিক সাম্য বলা হয়। মূলত সামাজিক দৃষ্টিতে সকল মানুষ সমান, সমমর্যাদাবান ও সমান সুযোগ- সুবিধাসম্পন্ন।
২. রাজনৈতিক সাম্য (Political equality)
রাজনৈতিক সাম্য রাজনৈতিক অধিকার (Political rights) ভোগের সমতাকে নির্দেশ করে। রাজনৈতিক অধিকার বলতে বোঝায় ভোটাধিকার, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অধিকার, মতামত প্রকাশের অধিকার ও সরকারি চাকরি লাভের অধিকারকে। রাজনৈতিক সাম্য ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার অন্যতম শর্ত হিসেবে ।
৩. অর্থনৈতিক সাম্য (Economic equality)
ধনবৈষম্যপূর্ণ সমাজে কখনই অধিকার ও স্বাধীনতার সুফল আশা করা যায় না। আবার, অর্থনৈতিক গণতন্ত্র ছাড়া রাজনৈতিক গণতন্ত্র অর্থহীন। সাম্য বলতে যদি ব্যক্তিত্ব বিকাশের পূর্ণ সুযোগ- সুবিধাকে বোঝায় তাহলে অর্থনৈতিক সামোর গুরুত্ব অত্যধিক। অর্থনৈতিক সাম্যের অনুপস্থিতিতে সাম্যের প্রকৃত আদর্শ ব্যর্থতায় নিমজ্জিত হয়।
৪. আইনগত সাম্য (Legal equality)
আইনের আলোকে সাম্য বা সমঅধিকার স্বীকৃত হলে আইনগত সাম্য প্রতিষ্ঠা পায়। আইনের চোখে সকলেই সমান, সকল ব্যক্তির জন্য আইন সমভাবে প্রযোজ্য- এটাই আইনগত সাম্যের মূল কথা। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাষ্ট্র যেহেতু একটি বিশেষ শ্রেণির প্রভুত্ব করে সেহেতু এরূপ রাষ্ট্র কখনই সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে পারে না।
৫. স্বাভাবিক সাম্য কি (Natural equality)
স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিক সাম্য বলতে বোঝায় জন্মগতভাবেই মানুষ সমান অধিকারসম্পন্ন। জন্মগতভাবে মানুষে মানুষে কোনো পার্থক্য নেই। সমান অধিকার সহজাত। এটাই স্বাভাবিক সাম্যের মূল কথা। আমেরিকার স্বাধীনতা ঘোষণায় স্বাভাবিক সাম্যের কথা উল্লেখ থাকলেও বর্তমানে এ ধারণার অবসান ঘটেছে। কেননা শক্তি-সামর্থ্য, বুদ্ধিবৃত্তি, প্রতিভা ও যোগ্যতা প্রভৃতির ক্ষেত্রে মানুষ সমানভাবে জন্মায় না। এসব ক্ষেত্রে পার্থক্য বিদ্যমান।
৬. নাগরিক সাম্য বা ব্যক্তিগত সাম্য (Individual equality)
নাগরিক সাম্য বা ব্যক্তিগত সাম্যের অর্থ হলো রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের সমান অধিকার। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের মধ্যে সাম্য বা ব্যক্তিগত সাম্য থাকতে হবে।
৭. শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সাম্য (Educational and cultural equality)
সামোর ধারণাকে শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সম্প্রসারিত করার বিষয়টি বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। সাংস্কৃতিক সাম্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো শিক্ষার ক্ষেত্রে সাম্য। বার্কার (Barker)-এর মতে, “রাষ্ট্র শিক্ষার ক্ষেত্রে ন্যূনতম অধিকার প্রদান করেছে। বর্তমান রাষ্ট্রে প্রাথমিক শিক্ষাকে সকলের জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। উন্নত গুণাবলি প্রমাণের জন্য উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও প্রবেশাধিকার সম্প্রসারিত করা হয়েছে।”
সাম্য ভিত্তিক সমাজ বাক্তির ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য অপরিহার্য। উল্লিখিত বিভিন্ন সাম্য ব্যবস্থার সফল বাস্তবায়ন সম্ভব হলে সমাজ যেমন সমৃদ্ধ হবে তেমনি ব্যক্তির উৎকর্যও সাধিত হবে। সাম্যের সফল বাস্তবায়ন আর ব্যক্তিত্বের উৎকর্ষ- এ দুয়ের সংমিশ্রণে সমাজ ও দেশ হয়ে উঠবে সমৃদ্ধ।
একটু আগে আমরা সাম্য কি ? তা জানলাম। সমাজ জীবনে সাম্যের গুরুত্ব অপরিসীম। সুখ-সমৃদ্ধ জীবনের জন্য সাম্য ভিত্তিক সমাজ অপরিহার্য। নিচে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোকপাত করা হলো।
১. সভ্য সমাজের প্রতিষ্ঠায়। সাম্যের মাধ্যমেই সভ্য সমাজব্যবস্থা বিকশিত হয়। কারণ সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠিত হলে সমাজের সকল শ্রেণির মানুষ সমান অধিকার উপভোগের সুযোগ লাভ করে। সাম্য বর্ণবৈষম্য বা সাংস্কৃতিক বৈষম্যমুক্ত সমাজ গঠন করে সমাজ সুন্দর করে তোলে।
২. শ্রেণিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠায়: একমাত্র সাম্য ব্যবস্থাই পারে শ্রেণিহীন সমাজ গড়ে তুলতে। যেখানে ধনী-গরিব, উঁচু-নিচু, রাজা-প্রজা, মালিক-শ্রমিক ইত্যাদি শ্রেণিভেদের অস্তিত্ব থাকে না।
৩. গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠায়। গণতান্ত্রিক সমাজ বলতে সমতা ভিত্তিক সমাজকেই বোঝায়। কারণ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় কোনো বিশেষ ব্যক্তি বা বিশেষ মহলের জন্য বিশেষ কোনো সুযোগ-সুবিধা লাভের সুযোগ থাকে না। তাই গণতন্ত্রকে অর্থবহ করে তোলার জন্য সাম্যের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
৪. অর্থনৈতিক স্বাধীনতা রক্ষায়। সাম্য ব্যবস্থা সমাজে কাউকে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলার সুযোগ দেয় না বা কাউকে একেবারে দারিদ্র্যের শিকার হতে দেয় না। সম্পদের সুষম বণ্টনের মাধ্যমে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য রোধ করে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সকলের সমান স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করতে সাম্যের গুরুত্ব খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
৫. সমৃদ্ধ সমাজ গঠনে। সমৃদ্ধ সমাজ বলতে সকলের সুখ-সমৃদ্ধিশীল জীবন ব্যবস্থাকে বোঝায়। আর এরূপ সমাজের রূপায়ণে সাম্য অপরিহার্য। সাম্য ভিত্তিক সমাজে সকলের সুখ-সমৃদ্ধ জীবন নিশ্চিত করা সম্ভব।
৬. ব্যক্তির স্বাধীনতা রক্ষায়। ব্যক্তির স্বাধীনতা রক্ষায় সাম্যের গুরুত্ব অপরিসীম। সমাজে অসাম্য বিরাজ করলে সবল বা সম্পদশালী ব্যক্তিরা দুর্বল ব্যক্তিদের ওপর প্রভাব বিস্তার করবে। এক্ষেত্রে দুর্বল ব্যক্তিদের পক্ষে স্বাধীনতা বজায় রাখা সম্ভব হবে না। কিন্তু সমাজে সাম্য বিরাজ করলে কেউ কারো ওপর হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।
৭. সামাজিক বৈষম্য রোধ সমাজে সুশাসন না থাকলে ধন-বৈষমা দেখা দেবে। এক্ষেত্রে বিত্তশালীরা বিলাসী জীবনযাপন করবে আর নিম্নবিত্তরা দুঃখ-কষ্টের মধ্যে জীবনযাপন করবে। তাই আয় ও বণ্টনের ক্ষেত্রে সমতা বিরাজ করলে সামাজিক বৈষম্য রোধ সম্ভব হবে।
৮. সামাজিক শান্তি ও সংহতি রক্ষা সমতা ছাড়া সমাজে শাস্তি ও সংহতি রক্ষা করা সম্ভব নয়। সাম্য সামাজিক অশান্তি দৃঢ় করে সমাজে শান্তি সৃষ্টি করতে পারে। সামাজিক বন্ধন ও সংহতি জোরদার হবে।
তাই সামাজিক শান্তি প্রতিষ্ঠায় সাম্যের গুরুত্ব অপরিসীম। উপর্যুক্ত আলোচনার নিরিখে প্রতীয়মান হয় যে, সমাজের সকল মানুষের মানবিক সত্তার বিকাশ এবং সেইসাথে সুখ-সমৃদ্ধ জীবন। উপভোগের জন্য সাম্যের গুরুত্ব অপরিসীম। এজন্য সাম্য ভিত্তিক সমাজ সকলেরই একান্ত কাম্য।
স্বাধীনতা ও সাম্যের সম্পর্ক
স্বাধীনতা ও সাম্য সম্পর্কে পরস্পরবিরোধী অভিমত প্রচলিত আছে। একদল মনে করেন উভয়ের মধ্যে বৈরী সম্পর্ক বিদ্যমান।কিছু ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রাম ও ফরাসি বিপ্লবের মূলমন্ত্র সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতা। এ বিষয়গুলোর মধ্যে পারস্পরিক পরিপূরক সম্পর্কের কথা নিহিত আছে। এমনকি উদারনৈতিক গণতন্ত্রের প্রবক্তাগণও সাম্য ও স্বাধীনতার মধ্যকার বিরোধিতাকে অস্বীকার করেছেন। সুতরাং উভয়ের মধ্যে বিরোধিতা নয়। বরং গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান। এ দুয়ের মধ্যে সম্পর্কের বিভিন্ন দিক নিয়ে নিম্নে আলোকপাত করা হলো।
১. সাম্যই স্বাধীনতার ভিত্তি: রুশো, লাস্কি, মেইটল্যান্ড প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মনে করেন যে, “সাম্য ও স্বাধীনতা পরস্পরের পরিপূরক ধারণা। সাম্যোর অস্তিত্ব ব্যতিরেকে স্বাধীনতার উপলব্ধি অসম্ভব।” রুশো বলেন, “সাম্য ছাড়া স্বাধীনতা টিকে থাকতে পারে না।” (“Liberty cannot exist without equality,”) স্বাধীনতার আদর্শকে বাস্তবে রূপায়িত করার জন্য সাম্যের পরিবেশ প্রয়োজন। আইনের মাধ্যমে সমান অধিকার স্বীকৃত হলে এবং অধিকার উপভোগের ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর হলে নাগরিকদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অন্যান্য অধিকার উপভোগ সম্ভবপর হয়ে ওঠে। বৈষম্যমূলক সমাজ ব্যবস্থায় স্বাধীনতা অর্থহীন।
২. একে অপরের পরিপূরক: অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সাম্য ও স্বাধীনতাকে অভিন্নরূপে দেখেছেন। যেমন- অধ্যাপক লাম্বি স্বাধীনতা সম্পর্কে বলেছেন, “এটা এমন এক পরিবেশ যে পরিবেশে মানুষ তার ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ সাধন করতে পারে। আবার সামাও এক ধরনের পরিবেশ যেখানে মানুষ তার ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশের সমান সুযোগ-সুবিধা লাভ করে। সুতরাং সাম্য ও স্বাধীনতা একে অপরের পরিপূরক।
৩. সাম্য স্বাধীনতার পূর্বশর্ত: রাষ্ট্রবিজ্ঞানী টনি (Turney)-এর মতানুসারে স্বাধীনতা বলতে যদি মানবতার নিরবচ্ছিন্ন প্রসার বোঝায়, তাহলে সেই স্বাধীনতা কেবল সাম্যভিত্তিক সমাজেই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। তিনি বলেন, সাম্য স্বাধীনতার পরিপন্থী নয়, স্বাধীনতার স্বার্থে একান্ত প্রয়োজন। রাষ্ট্র একদিকে যেমন আইনের মাধ্যমে স্বাধীনতা সৃষ্টি ও সংরক্ষণ করে তেমনি স্বাধীনতা সংরক্ষণের স্বার্থে আইনের মাধ্যমে সাম্যভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা করে, যেখানে সকলের সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত হয়।
৪. সাম্য ও স্বাধীনতা অধিকারের সংরক্ষক। স্বাধীনতা হলো নাগরিক অধিকার সংরক্ষণের একটি পূর্নর্শত। আইনের দৃষ্টিতে সকলে সমান। আইনের মাধ্যমে সমানাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। তাছাড়া সাম্য জাতি, ধর্ম, বর্ণ স্কুলে সমান অধিকার ভোগের সুযোগ করে দেয়।
৫. অর্থনৈতিক সাম্য: মাকর্সবাদী দার্শনিকগণ সাম্য ও স্বাধীনতার সম্পর্ককে ইতিবাচক হিসেবে দেখেছেন। তারা অর্থনৈতিক সাম্যকে স্বাধীনতার পূর্বশর্ত হিসেবে গণ্য করেছেন। এ মতানুসারে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় প্রকৃত অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
সাম্য ও স্বাধীনতার মধ্যকার সম্পর্ক অতি নিবিড়। যারা মনে করেন যে, উভয়ের মধ্যে বৈরী ও তিক্ত সম্পর্ক বিদ্যমান, তারা সাম্যের অর্থ সম্পর্কে সম্যক অবহিত নন। এটা তাদের সাম্য ও স্বাধীনতা সম্পর্কিত ভ্রান্ত ধারণাপ্রসূত সিদ্ধান্ত। বস্তুত, সাম্য ও স্বাধীনতার মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ভিত্তিতেই সমাজে সমতা বিরাজ করে এবং স্বাধীনতা উপভোগ সহজতর হয়। সাম্য ভিত্তিক সমাজেই স্বাধীনতা অর্থপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। এতক্ষণ আমরা সাম্য কি ? সাম্যের গুরুত্ব ও শ্রেণিবিভাগ সম্পর্কে জানলাম চলো এইবার দেখে আসি সাম্য সম্পর্কে কিছু বহুল আলোচিত প্রশ্ন ও উত্তর ।
কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ও উত্তর
সাম্য কি ?
উত্তর: সবার জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা প্রদানই হলো সাম্য।
সাম্য কাকে বলে ?
উত্তর: জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী ও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমাজের সকল মানুষের সমান সুযোগ-সুবিধা, অধিকার ও স্বাধীনতা ভোগ করাকে সাম্য বলে ।
সাম্য অর্থ কি ?
উত্তর: সাম্য অর্থ হলো “সমান অধিকার” ।
সাম্যের অর্থ কি ?
উত্তর: সাম্য অর্থ সমান অধিকার ।
সাম্যের সংজ্ঞা দাও ?
উত্তর: জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী ও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমাজের সকল মানুষের সমান সুযোগ-সুবিধা, অধিকার ও স্বাধীনতা ভোগ করাকে সাম্য বলে । সকলের জন্য সমান সুযোগ সুবিধা প্রদান করার প্রক্রিয়াকেই সাম্য বলা হয় ।
সাম্য বলতে কি বুঝায় ?
উত্তর: জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী ও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমাজের সকল মানুষের সমান সুযোগ-সুবিধা, অধিকার ও স্বাধীনতা ভোগ করাকে সাম্য বলে । সকলের জন্য সমান সুযোগ সুবিধা প্রদান করার প্রক্রিয়াকেই সাম্য বলা হয় ।
রাজনৈতিক সাম্য বলতে কি বুঝায় ?
উত্তর: রাজনৈতিক সাম্য রাজনৈতিক অধিকার (Political rights) ভোগের সমতাকে নির্দেশ করে। রাজনৈতিক অধিকার বলতে বোঝায় ভোটাধিকার, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অধিকার, মতামত প্রকাশের অধিকার ও সরকারি চাকরি লাভের অধিকারকে।
সামাজিক সাম্য বলতে কী বোঝায় ?
উত্তর: সামাজিক সাম্য বলতে বোঝায় সমাজের দৃষ্টিতে মানুষের সংঙ্গে মানুষের সমতা। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, বংশ-মর্যাদা, প্রভাব-প্রতিপত্তি নির্বিশেষে যখন কোনো মানুষের সাথে কোনো মানুষের পার্থক্য নিরূপণ করা হয় না তখন তাকে সামাজিক সাম্য বলা হয়।
অর্থনৈতিক সাম্য কি ?
ধনবৈষম্যপূর্ণ সমাজে কখনই অধিকার ও স্বাধীনতার সুফল আশা করা যায় না। আবার, অর্থনৈতিক গণতন্ত্র ছাড়া রাজনৈতিক গণতন্ত্র অর্থহীন। সাম্য বলতে যদি ব্যক্তিত্ব বিকাশের পূর্ণ সুযোগ- সুবিধাকে বোঝায় তাহলে অর্থনৈতিক সামোর গুরুত্ব অত্যধিক। অর্থনৈতিক সাম্যের অনুপস্থিতিতে সাম্যের প্রকৃত আদর্শ ব্যর্থতায় নিমজ্জিত হয়।
আইনগত সাম্য কি ?
আইনের আলোকে সাম্য বা সমঅধিকার স্বীকৃত হলে আইনগত সাম্য প্রতিষ্ঠা পায়। আইনের চোখে সকলেই সমান, সকল ব্যক্তির জন্য আইন সমভাবে প্রযোজ্য- এটাই আইনগত সাম্যের মূল কথা। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাষ্ট্র যেহেতু একটি বিশেষ শ্রেণির প্রভুত্ব করে সেহেতু এরূপ রাষ্ট্র কখনই সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে পারে না।