প্রেষণার একটি অতি গুরুত্বপুর্ণ বিষয় হচ্ছে কর্মীদেরকে উৎসাহিত করে তাদের কাছ থেকে কাজ আদায় করে নেওয়া । মাসলোর চাহিদা সোপান তত্ত্ব আমাদের মানুষের সাইকোলজিক্যাল দিকগুলো ব্যাখ্যা করার মাধ্যমে প্রেষণা প্রদান সহজতর করেছে । আজকে আমরা মাসলোর চাহিদা সোপান তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করবো ও এর সমালোচনা করবো কোথায় এই তত্ত্বের ব্যাত্যয় রয়েছে ।
মাসলোর চাহিদা সোপান তত্ত্ব সমালোচনা সহ আলোচনা কর ।
প্রেষণার তত্ত্বগুলোর মধ্যে চাহিদা সোপান তত্ত্বটি সর্বাধিক জনপ্রিয়। প্রখ্যাত মার্কিন মনোবিজ্ঞানী A. H. Maslow চাহিদা সোপান তত্ত্বের উদ্ভাবক। ১৯৪৩ সালের জুলাই মাসে Psychological Review নামক একটি পত্রিকায় ‘A Theory of Human Motivation’ নামে একটি প্রবন্ধে তিনি তত্ত্বটি প্রকাশ করেন।
মূল ধারণা হলো মানুষের প্রেষণার মূলে রয়েছে তার চাহিদা বা অভাববোধ। মাসলো মনে করেন মানুষের একটি অভাব পূরণ হওয়ার পর তার মধ্যে আরেকটি অভাব দেখা দেয়। এরূপ পরিবর্তনের ধারায় মানুষকে কীভাবে প্রেষিত করা যায় মাসলো এ সম্পর্কে যে তত্ত্ব দিয়েছেন তাকে মাসলোর চাহিদা সোপান তত্ত্ব বলে। মাসলো তার এ তত্ত্বে মানুষের অভাব বা চাহিদাকে পাঁচটি ভাগে ভাগ করেছেন। নিচে মাসলোর চাহিদা সোপান তত্ত্বটি রেখাচিত্রের মাধ্যমে উপস্থাপন করে আলোচনা করা হলো:
১. জৈবিক চাহিদা (Physiological needs)
জৈবিক অভাবগুলো মূলত মানুষের শারীরিক চাহিদার সাথে সম্পৃক্ত। মানুষের ন্যূনতম বাঁচার প্রয়োজনে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা ইত্যাদিকে জৈবিক চাহিদা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এগুলো মানুষের জীবন রক্ষার জন্য অপরিহার্য। এসব অভাব কমবেশি সার্বজনীন বলে মনে করা হয়।
২. নিরাপত্তার চাহিদা (Safety needs)
মানুষের জৈবিক চাহিদা মেটানোর পর তার মধ্যে নিরাপত্তার চাহিদা জাগ্রত হয়। চাহিদার এ পর্যায়ে কর্মীর জীবনের নিরাপত্তা, চাকরির নিরাপত্তা, অবসরকালীন সুযোগ-সুবিধা ও চিকিৎসা সুবিধা ইত্যাদি নিরাপত্তার চাহিদার অন্তর্ভুক্ত। এসব অভাব পূরণের মাধ্যমে কর্মীকে কার্যসম্পাদনে প্রণোদিত করা যায়।
৩. সামাজিক চাহিদা (Social needs/Love & Belongings)
জৈবিক ও নিরাপত্তার চাহিদা পূরণ হওয়ার পর মানুষের মধ্যে সামাজিক চাহিদা জাগ্রত হয়। মানুষের কর্মপ্রেরণায় ও আচরণে এ চাহিদার প্রভাব অসীম। প্রকৃতিতে মানুষ সামাজিক জীব। তাই সে অন্যের সংস্পর্শে আসতে চায়, মানুষের ভালোবাসা চায়। সামাজিক চাহিদা বলতে মানুষ বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনের সাথে মিশতে চায় এবং সে অন্যদের ভালোবাসা পাওয়ার প্রত্যাশা করে ।
৪. আত্মতৃপ্তি বা আত্মমর্যাদার চাহিদা (Esteem needs)
আত্মমর্যাদার চাহিদায় মানুষ নিজেকে সমাজের অন্যদের থেকে অর্থাৎ বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়-স্বজন থেকে নিজেকে একটু উচ্চতায় নিয়ে যেতে চায়। এরূপ চাহিদা ব্যক্তির সুনাম-সুখ্যাতি, অহংকার, যশ ইত্যাদির সাথে সংশ্লিষ্ট। এ পর্যায়ে সে দামি গাড়ি, দামি বাড়ি, দামি অলংকার, বড় চাকরি ইত্যাদির অভাববোধ করে ।
৫. আত্মপ্রতিষ্ঠার বা আত্মপূর্ণতার চাহিদা (Self-actualization needs)
মাসলোর চাহিদা তত্ত্ব অনুযায়ী এটি মানবচাহিদার সর্বশেষ কিংবা সর্বোচ্চ ধাপ। এ পর্যায়ে একজন মানুষ সভা-সমিতিতে বক্তব্য প্রদান, শিল্প সাহিত্যে অবদান, সমাজসেবা ইত্যাদি কাজের মাধ্যমে নিজের সৃজনশীলতা ও বিশেষ গুণের বিকাশ ঘটিয়ে এ ধরনের চাহিদা পূরণ করতে সচেষ্ট হয়। এ পর্যায়ে সে নিজেকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যেতে চায় যেন মানুষ মৃত্যুর পরও তাকে স্মরণে রাখে।
আরও পড়ুন >>> প্রেষণা তত্ত্ব সমূহ! ৯ টি প্রেষণা তত্ত্বের বর্ণনা !
মাসলোর চাহিদা সোপান তত্ত্ব এর সমালোচনা (Criticism of theory)
মাসলোর তত্ত্বকে অনেক সমালোচক সমালোচনা করতে গিয়ে যা বলেছেন তা হলো:
ক. মাসলো মানবজীবনের চাহিদার যে পর্যায়ক্রমিক স্তর দেখিয়েছেন সেটি উন্নত দেশগুলোতে এবং সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে প্রভাবিত নাও হতে পারে।
খ. সন্তুষ্টি পরিমাপ করা যায় না কারণ এর কোনো মাপকাঠি নেই।
গ. পর্যায়ক্রমে চাহিদা না হয়ে একই সঙ্গে সবগুলো চাহিদা দেখা দিতে পারে।
ঘ. মানুষের লক্ষ্য অর্জনের বিকল্প চিন্তাধারা থাকতে পারে।
৩. আত্মতৃপ্তির চাহিদা ব্যক্তি ও সৃষ্টির ওপর নির্ভর করে।
চ. এ তত্ত্বে বলা হয়েছে মানুষের একটি চাহিদা পূরণসাপেক্ষে কর্মীর মধ্যে পরবর্তী চাহিদা দেখা দেয় মাসলোর এ বস্তুবতা ঠিক নয়।
পরিশেষে বলা যায়, সব সমাজে বা পরিবেশে এ তত্ত্বটি সমভাবে প্রযোজ্য নয়। তাই মাসলোর চাহিদা তত্ত্বটি নিন্দিত।
পক্ষান্তরে, মাসলোর চাহিদা সোপান তত্ত্বটি অনেক ব্যবস্থাপনাবিশারদ কর্তৃক ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়েছে। কারণ এ প্রেষণা তত্ত্ব এর মূল ধারণা হলো মানুষের প্রেষণার মূলে রয়েছে তার চাহিদা বা অভাববোধ। মাসলো মনে করেন মানুষের একটি অভাব পূরণ হওয়ার পর তার মধ্যে আরেকটি অভাব দেখা দেয়। বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্য আছে বলে অনেক ব্যবস্থাপনা বিশারদ মনে করেন তাই এ তত্ত্বটির ব্যবহার ও সমর্থনের পক্ষে ব্যাপক যৌক্তিকতা রয়েছে ।