প্রেষণার তত্ত্ব সমূহ
ব্যবস্থাপনার প্রধান উদ্দেশ্য হলো কর্মীদের কাছ থেকে সর্বাধিক কাজ আদায় করে নেওয়া। কিন্তু এটি জটিল ও কঠিন কাজ। তাই কর্মীদেরকে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করার মাধ্যমে তাদের কাছ থেকে সর্বাধিক কাজ আদায়ের জন্য প্রয়োজন প্রেষণা। যা একটি মনস্তাত্ত্বিক বিষয় ।
প্রেষণা তত্ত্ব
প্রেষণার মাধ্যমে কর্মীদেরকে উৎসাহিত ও অনুপ্রানিত করার মাধ্যমে তাদের কাছ থেকে সর্বাধিক কাজ আদায় করে নেওয়ার বিভিন্ন পন্থায় হলো প্রেষণা তত্ত্ব । প্রেষণা সম্পর্কে ব্যবস্থাপনাবিদগণ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন তত্ত্ব উদ্ভাবন করেছেন। এসব তত্ত্বের মাধ্যমে ব্যবস্থাপনাবিদগণ মানুষের আচরণ, চাহিদা, সন্তুষ্টি, অসন্তুষ্টি, প্রেষণা, কৌশল ইত্যাদি সম্পর্কে বিভিন্ন মত পোষণ করেছেন। নিচে প্রেষণার উল্লেখযোগ্য তত্ত্বসমূহ আলোচনা করা হলো:
১. চাহিদা সোপান তত্ত্ব (Need hierarchy theory)
প্রেষণা তত্ত্ব গুলোর মধ্যে চাহিদা সোপান তত্ত্বটি অন্যতম। প্রখ্যাত মার্কিন মনোবিজ্ঞানী A. H. Maslow (১৯০৮-১৯৭০) চাহিদা সোপান তত্ত্বের উদ্ভাবক। এ প্রেষণা তত্ত্ব এর মূল ধারণা হলো মানুষের প্রেষণার মূলে রয়েছে তার চাহিদা বা অভাববোধ। মাসলো মনে করেন মানুষের একটি অভাব পূরণ হওয়ার পর তার মধ্যে আরেকটি অভাব দেখা দেয়। এ অভাব বা চাহিদাকে তিনি পাঁচ ভাগে ভাগ করেছেন। চাহিদাগুলো হলো:
ক. জৈবিক চাহিদা;
খ. নিরাপত্তার চাহিদা;
গ. সামাজিক চাহিদা;
ঘ. আত্মমর্যাদার চাহিদা ও
ঙ. আত্মপ্রতিষ্ঠার চাহিদা
মাসলোর চাহিদা সোপান তত্ত্ব সম্পর্কে আরও বিস্তারিত পড়তে এই পোস্টটি পড়ুন >>> মাসলোর চাহিদা সোপান তত্ত্ব এর 5টি স্তর সমালোচনা সহ আলোচনা কর ।
২. ই.আর.জি. তত্ত্ব (ERG theory)
ই.আর.জি. তত্ত্বের উদ্ভাবক হলেন Clayton Alderfer। মাসলোর তত্ত্বটি বিভিন্নভাবে সমালোচিত হওয়ায় ১৯৬১ সালে তিনি এ তত্ত্বটি উদ্ভাবন করেন। এক্ষেত্রে তিনি মানুষের অভাব বা চাহিদাকে তিনটি ভাগে ভাগ করেন। চাহিদাগুলো হলো:
ক. টিকে থাকার চাহিদা;
খ . সম্পৃক্ততার চাহিদা ও
গ. প্রবৃদ্ধির চাহিদা ।
এ তত্ত্বে মনে করা হয়, একটা চাহিদা পূরণ হলে বা পূরণের পর্যায়ে এলে স্বভাবতই অন্য একটি চাহিদা দেখা দেয়। তবে প্রথম পর্যায়ে চাহিদার বিষয়টি যতটা দৃঢ় থাকে পরবর্তী ক্ষেত্রে তা অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে যায়। মাসলোর তত্ত্ব অপেক্ষা এ তত্ত্বটি অধিক নমনীয় ।
৩. সাফল্য অর্জন ধারণা তত্ত্ব (Acquired needs theory)
সাফল্য অর্জন ধারণা তত্ত্বটি উদ্ভাবন করেন প্রখ্যাত মনোবিজ্ঞানী David C. McCelland। তিনি মনে করেন কোনো ব্যক্তিকে যদি সাফল্য অর্জন সম্বন্ধে তত্ত্বমূলক জ্ঞান দান করা যায় এবং তার উন্নতি সম্বন্ধে ধারণা দেওয়া যায় তাহলে সে অধিক দক্ষতার সাথে কার্যসম্পাদন করার চেষ্টা করবে। তিনি কর্মক্ষেত্রে কর্মীদের তিন ধরনের চাহিদা শনাক্ত করেন। চাহিদাগুলো হলো:
ক. কৃতিত্ব বা সাফল্য অর্জনের চাহিদা;
খ. স্বীকৃতিপ্রাপ্তির চাহিদা ও
গ. ক্ষমতাপ্রাপ্তির চাহিদা।
৪. দ্বি-উপাদান তত্ত্ব (Two factors theory)
প্রখ্যাত মার্কিন মনোবিজ্ঞানী Frederick Herzberg ১৯৫৯ সালে ১১টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ২০০ জন প্রকৌশলী ও হিসাবরক্ষকের ওপর গবেষণা চালিয়ে প্রেষণার দ্বি-উপাদান তত্ত্বটি আবিষ্কার করেন। এ গবেষণার দ্বারা তিনি কর্মীদের কার্যে সন্তুষ্টির জন্য দুটি উপাদানের সন্ধান পান। এদের মধ্যে একটিকে প্রণোদনামূলক বা সন্তুষ্টিমূলক এবং অন্যটিকে হাইজিন বা অসন্তুষ্টিমূলক উপাদান হিসেবে আখ্যায়িত করেন। …READ MORE
৫. X তত্ত্ব ও Y তত্ত্ব (X & Y theory)
আমেরিকান চিন্তাবিদ Douglas McGregor (১৯০৬-১৯৬৪) ১৯৫৭ সালে তাঁর “The Human Side of Enterprise” নামক গ্রন্থে কর্মীদের অনুপ্রাণিত করার জন্য দুটি বিপরীতধর্মী তত্ত্বের কথা উল্লেখ করেছেন। মানুষের আচরণের ওপর ভিত্তি করে তত্ত্ব দুটিকে তিনি X ও Y নামে অভিহিত করেন। নিচে তত্ত্ব দুটি আলোচনা করা হলো:
ক. X তত্ত্ব (X theory): X তত্ত্বে ডগলাস ম্যাকগ্রেগর মানুষের প্রকৃতি ও আচরণ সম্পর্কে একটি গতানুগতিক বা চিরাচরিত বা নেতিবাচক বা স্বৈরাচারী ধারণার কথা উল্লেখ করেছেন। এ তত্ত্বের মূল ধারণা হলো মানুষ জন্মগতভাবে কাজ অপছন্দ করে। তারা কাজে অলসতা, ফাঁকিবাজি, কাজ এড়িয়ে চলা এবং দায়িত্ব পালনে অনীহা প্রকাশ করে। তাই তাদেরকে দিয়ে কাজ করাতে হলে ভয়ভীতি, শান্তি ও চাপ প্রয়োগ করতে হয়।
খ. Y তত্ত্ব (Y theory): Y তত্ত্বকে আধুনিক, ইতিবাচক এবং গণতান্ত্রিক তত্ত্ব হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এ তত্ত্বের মূল ধারণা হলো মানুষ কাজকে খেলাধূলার মতো পছন্দ করে। তারা সৃজনশীল, দায়িত্ব অনুসন্ধান করে এবং তারা স্ব-নির্দেশনায় কার্যসম্পাদন করে। এজন্যে কর্মীদেরকে ভয়ভীতি বা বলপ্রয়োগের প্রয়োজন হয় না।।।
৬. প্রত্যাশা তত্ত্ব (Expectancy theory)
১৯৬৪ সালে বিশিষ্ট মনোবিজ্ঞানী Victor H. Vroom এ তত্ত্বের উদ্ভাবন করেন। এ তত্ত্বের মূল ধারণা হচ্ছে যে কাজের মধ্যে মানুষ তার লক্ষ্য অর্জনে যত বেশি সম্ভাবনা দেখতে পায় উত্ত কাজ সম্পাদনের জন্য তার প্রচেষ্টা এবং আগ্রহ তত বৃদ্ধি পায়। এ প্রেষণা তত্ত্ব তিনটি ধারণাকে মূল ভিত্তি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। যা নিম্নোক্ত সমীকরণের মাধ্যমে তিনি প্রকাশ করেন:
M = ExIxV
যেখানে,
M = Motivation (প্রেষণা)
E = Expectancy (প্রত্যাশা)
I = Instrumentality (সহায়তা)
V = Valence (আকর্ষণ)
৭. ন্যায়পরায়ণতা তত্ত্ব (Equity theory)
১৯৬৫ সালে বিশিষ্ট মনোবিজ্ঞানী Stacey Adams প্রেষণার ন্যায়পরায়ণতা তত্ত্ব টি উদ্ভাবন করেন। এরূপ প্রেষণা তত্ত্ব আর্থিক সুযোগ-সুবিধাকে কর্মস্থলে প্রেষণাদানের উপায় হিসেবে গণ্য করা হয়। এছাড়া এ তত্ত্ব অনুযায়ী মনে করা হয় মানুষের কার্যসন্তুষ্টি ও কার্যসম্পাদন নির্ভর করে। কর্মক্ষেত্রে বিদ্যমান ন্যায়-অন্যায়ের উপর। মানুষ কর্মক্ষেত্রে তার অবদানের জন্য কতটুকু পুরস্কার পাচ্ছে এবং সে পুরস্কার সমপর্যায়ের অন্য কোনো ব্যক্তির তুলনায় কম না বেশি মানুষ তা বিবেচনা করে। প্রাপ্য পুরস্কার অন্যের তুলনায় কম হলে অসন্তুষ্টি হয় এবং বেশি হলে প্রেষিত হয়।
৮. অংশগ্রহণ তত্ত্ব (Participation theory)
প্রখ্যাত মনীষী Rensis Likert অংশগ্রহণমূলক ব্যবস্থাপনার ওপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করেন। এটি মূলত অংশগ্রহণমূলক ব্যবস্থাপনা ধারণা থেকে সংগৃহীত। এ প্রেষণা তত্ত্ব প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত শ্রমিক-কর্মীদের প্রতিষ্ঠানের যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের অংশগ্রহণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এতে কর্মীদের অভাব-অভিযোগ উর্ধ্বতন কর্মকর্তার নিকট পেশ করে সমাধানের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। এতে কর্মিগণ প্রেষিত হয়ে থাকে। যা তাকে দায়িত্বশীলতার সাথে কর্মসম্পাদনে উৎসাহিত করে।
৯. Z তত্ত্ব (Z theory)
জাপানি অধ্যাপক William G. Ouchi (১৯৪৩) শ্রমিক-কর্মীদের প্রণোদিত করার জন্য ১৯৮১ সালে “How American Business Can Meet Japanese Challenger” নামক গ্রন্থের মাধ্যমে সর্বপ্রথম তিনি এ তত্ত্ব প্রবর্তন করেন। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের কয়েকটি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে কয়েক বছর গবেষণা চালান। এ গবেষণার মাধ্যমে তিনি Z তত্ত্বের প্রবর্তন করেন। এ অনুযায়ী কর্মীদের প্রণোদিত করার জন্য আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্কের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। কেননা কর্মীদের মধ্যে আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্ক ভালো হলে যেকোনো কাজ তাদের কাছ থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে করানো যায়।
পরিশেষে বলা যায়, প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন কার্যের ভিত্তিতে নিয়ন্ত্রণের জন্য ভিন্ন ভিন্ন কার্যপদ্ধতি বা কৌশল বা প্রেষণা তত্ত্ব ব্যবহার করা হয়। তবে আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় পারে একটি প্রতিষ্ঠানকে সঠিক লক্ষ্যে পৌঁছাতে।