আসসালামুও্যালাইকুম! আশা করি সকলেই ভালো আছেন । অনেকেই প্রেষণা চক্র কি ? ও প্রেষণা দানের উপায় নিয়ে আলোচনা করতে বলেছেন । তাই আজকে আমরা আলোচনা করবো প্রেষণা চক্র কি এবং প্রেষণা দানের উপায় বা পদ্ধতিসমুহ নিয়ে ।
প্রেষণা চক্র কি ? ও প্রেষণা দানের উপায় বা পদ্ধতিসমূহ আলোচনা কর ।
প্রেষণা চক্র কি তা নিয়ে আলোচনা করার আগে আমাদের জানতে হবে প্রেষণা সম্পর্কে ! না জানলে এই আর্টিকেলটি আগে পড়ে আসুন >>> প্রেষণা কি বা কাকে বলে ? প্রেষণার বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব !
প্রেষণা চক্র কি ?
একজন কর্মীর অভাব পূরণের পর প্রেষণার কখনো পরিসমাপ্তি ঘটে না কারণ মানুষের একটি অভাব পূরণের পর আরেকটি অভাব দেখা দেয়। এভাবে প্রেষণা চক্রাকারে আবর্তিত হয়।
মানুষের আচরণ প্রাকৃতিক । মানুষ কী চিন্তা করে তা অন্যরা জানে না। তাই মানুষের মনোভাব নির্ণয় বেশ জটিল। মনের সাথে সাধারণ আচরণের যেমন সম্পর্ক রয়েছে তেমনি আচরণের সম্পর্ক প্রেষণার সাথে। প্রেষণা প্রক্রিয়া কতকগুলো ধাপে বিভক্ত। এ ধাপগুলো পর্যায়ক্রমে সম্পাদিত হয়। পর্যায়ক্রমে সম্পাদিত ধাপগুলোর সমন্বয়ে যে প্রেষণা সম্পন্ন হয় সেগুলোর সমষ্টিকে প্রেষণাচক্র বলে ।
একজন কর্মীর প্রয়োজন হতে অভাববোধ সৃষ্টি হয়। অভাববোধ হতে তা মিটানোর জন্য কাজের প্রতি আগ্রহ জেগে ওঠে। অভাব পূরণের পর প্রেষণার কখনো পরিসমাপ্তি ঘটে না কারণ মানুষের একটি অভাব পূরণের পর আরেকটি অভাব দেখা দেয়। এভাবে প্রেষণা চক্রাকারে আবর্তিত হয়।
বিভিন্ন মনীষী প্রেষণা চক্র কি ? এবং এর প্রক্রিয়াকে বিভিন্নভাবে বিশ্লেষণ করেছেন।
জি.আর. টেরি এবং স্টিপেন ফ্রাঙ্কলিন (G.R Terry and Stephen Franklin) প্রেষণা প্রক্রিয়াকে ব্যক্তিক চাহিদা বা আকাঙ্ক্ষা, তাড়না এবং লক্ষ্যসমূহ প্রভৃতি ধাপে বিশ্লেষণ করেছেন।
আর.ডব্লিউ গ্রিফিন (R.W. Griffin) প্রেষণাকে অভাব, সন্তুষ্টি অর্জনের উপায়সমূহ অনুসন্ধান, অভাব পূরণের আচরণ নির্ধারণ, সন্তুষ্টি অর্জন মূল্যায়ন, ভবিষ্যৎ অভাব নির্ধারণ ও সন্তুষ্টি অর্জনের অনুসন্ধান, অতৃপ্ত চাহিদা, লক্ষ্যাভিমুখী আচরণ এবং সন্তুষ্টি অর্জন প্রভৃতি ধাপে বিশ্লেষণ করেছেন।
ব্যবস্থাপনা বিশারদগণের বক্তব্য বিশ্লেষণ করে নিচে প্রেষণা চক্র কি ? তা রেখাচিত্রের সাহায্যে উপস্থাপনপূর্বক আলোচনা করা হলো:
১. কর্মীদের অভাব (Needs of employee): অভাব থেকে কর্মীদের প্রেষণা শুরু হয়। জৈবিক অথবা মনস্তাত্ত্বিক অসমতাই মূলত অভাবের জন্ম দেয়। প্রেষণাচক্রের প্রথম ধাপ হচ্ছে প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত কর্মীদের সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করা। কেননা এ প্রয়োজন হতেই কর্মীদের চাহিদার সৃষ্টি হয়। কাজেই ব্যবস্থাপনাকে কর্মীদের প্রয়োজন ও আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে হবে।
২. উদ্বিগ্নতা (Tension): উদ্বিগ্নতা কর্মীর এক ধরনের মানসিক অবস্থা। যা তার চিত্তকে অস্থির করে তোলে। অভাববোধ থেকে উদ্বিগ্নতা জন্ম নেয়। উদ্বিগ্নতা দূর করার জন্যে কর্মীরা বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত হয়। এ উদ্বিগ্নতার মাত্রা যতবেশি হবে, কর্মীরা তত মাত্রায় নিজেদেরকে সম্পৃক্ত না করার চেষ্টা করবে।
৩. তাড়না (Drives): উদ্বিগ্নতা হতে তাড়না হয়। কর্মীদের মধ্যে অভাব অনুভূত হলে সেই অভাব পূরণের জন্য তাড়না অনুভব করে। অতিমাত্রায় কঠোর পরিশ্রম থেকে বোঝা যায় অভাববোধ থেকে সৃষ্ট উত্তেজনা ও অস্থিরতা দূর করার জন্য কর্মীরা তাড়িত হচ্ছে।
৪. লক্ষ্যাভিমুখী আচরণ (Goal directed behavior): তাড়না থেকে কর্মী লক্ষ্যাভিমুখে ধাবিত হয়। এতে তার আচরণিক পরিবর্তন ঘটে। মানুষ তখন লক্ষ্য পূরণের মাধ্যমে সন্তুষ্টি অর্জন করে এবং পরিতৃপ্ত হয়।
৫. অভাব পূরণ (Need achievement): এ পর্যায়ে কর্মী তার কর্ম প্রচেষ্টা দ্বারা অভাব পূরণে সক্ষম হয়। এ অভাব পূরণই কর্মীর লক্ষ্য। লক্ষ্য অর্জনের মধ্য দিয়ে কর্মীর দীর্ঘ সময়ের চাওয়া-পাওয়ার পরিসমাপ্তি ঘটে।
৬. সন্তুষ্টি অর্জন (Need satisfaction): কর্মীদের মধ্যে সৃষ্ট অভাব পূরণের মধ্য দিয়ে তাদের মধ্যে সন্তুষ্টি আসে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তাদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে চাহিদা পূরণ করে সন্তুষ্টি অর্জন করা হয়। এটি প্রেষণা প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত পর্যায়।
৭. উদ্বেগ হ্রাস (Reduction of tension): প্রেষণা প্রক্রিয়ায় শুরুতে কর্মীদের মধ্যে সৃষ্ট অভাববোধ থেকে তাদের মধ্যে যে উদ্বেগের জন্ম হয় কর্মীদের সন্তুষ্টি অর্জনের মধ্য দিয়ে এ পর্যায়ে সে উদ্বেগের অবসান ঘটে এবং তারা স্বাভাবিক কর্মধারায় ফিরে আসে।
উল্লিখিত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানে কর্মীদের মধ্যে প্রেষণা প্রক্রিয়া কার্যকর থাকে। এ প্রক্রিয়ার শুরুতেই কর্মীদের মধ্যে বিভিন্ন অভাব বা আকাঙ্ক্ষার জন্ম লাভ করে এবং বিকশিত হয়। অতঃপর অভাববোধ মেটানোর জন্য কর্মীদের মধ্যে কার্য সম্পাদনের অনুকূল পরিবেশ ও মানসিকতা তৈরি হয়।
প্রেষণাদানের উপায় বা পদ্ধতিসমূহ
প্রেষণাদানের প্রথমেই যে বিষয়টি চিন্তা করা প্রয়োজন সেটা হলো মানুষের চাহিদা বা প্রয়োজন। মানুষের চাহিদার ওপর ভিত্তি করে প্রেষণা প্রক্রিয়াটি প্রয়োগ করা হয়। বিভিন্ন অবস্থা এবং চাহিদার উপর ভিত্তি করে প্রেষণাদান পদ্ধতিকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা:
ক. প্রেষণাদানের আর্থিক উপায় এবং
খ. প্রেষণাদানের অনার্থিক উপায়।
প্রেষণাদানের আর্থিক উপায়
প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিক-কর্মীদের অভাব পূরণের লক্ষ্যে প্রেষণার যে আর্থিক উপায় অবলম্বন করা হয় তাকে প্রেষণার আর্থিক উপায় হিসেবে অভিহিত করা হয়। এটি অর্থের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত। প্রতিষ্ঠানের নিম্নশ্রেণির কর্মীদের জন্য আর্থিক প্রেষণাদান পদ্ধতি সবচেয়ে বেশি কার্যকর। নিচে কর্মীদের প্রেষণাদানের আর্থিক উপায় বা পদ্ধতি আলোচনা করা হলো:
১. ন্যায্য মজুরি ও বেতন : কোনো প্রতিষ্ঠানে শ্রমিক-কর্মীদের মজুরি এবং বেতন ন্যায্য ধার্য করা হলে তারা কর্মে প্রণোদিত হয়। অন্যথায় তারা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। তাই শ্রমিক-কর্মীদের মজুরি এবং বেতন অবশ্যই যুক্তিসঙ্গত হওয়া বাঞ্ছনীয়। আর্থিক প্রেষণার মধ্যে সবচেয়ে কার্যকর উপায় হচ্ছে ন্যান্য বেতন।
২. বোনাস : কর্মীদের প্রেষণা সৃষ্টির জন্য বোনাস খুবই ফলপ্রদ পদ্ধতি। কাজে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত বা আকৃষ্ট করার জন্য উৎসব, উৎপাদন, দক্ষতা প্রভৃতি বৃদ্ধির জন্য বোনাস দেওয়া হয়। সুতরাং এটি প্রেষণাদানের একটি অন্যতম আর্থিক উপায়।
৩. আবাসিক সুবিধা : কর্মীদের মৌলিক অভাবগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে বাসস্থান। প্রতিষ্ঠান কর্মীদের বাসস্থানের সুবিধা দিয়ে কাজে প্রণোদিত করে থাকে। বাসস্থানের ব্যবস্থা করা সম্ভব না হলে সেক্ষেত্রে পদমর্যাদার ভিত্তিতে কর্মীদের বাসস্থান ভাতা প্রদান করে থাকে। এর ফলে কর্মীরা নিরাপদ বোধ করে এবং কাজে উৎসাহী হয়।
৪. চিকিৎসা সুবিধা : প্রবাদে আছে ‘স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল।’ কর্মীদের সুস্বাস্থ্য ও মনোবল বৃদ্ধির জন্য চিকিৎসা সুবিধা দেওয়া হয়। চিকিৎসা সুবিধা কর্মীর সুস্থতা ও মনোবল বাড়াতে সাহায্য করে।
৫. মুনাফার অংশ : মুনাফা মালিকের প্রাপ্য। মুনাফার একটি অংশ যদি কর্মীদের দেওয়া হয় তাহলে কর্মীরা কাজে অধিক মনোযোগী হয় এবং মুনাফা বৃদ্ধিতে সচেষ্ট থাকে। এটি কর্মীদের প্রেষণা দানের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি।
৬. পরিবহন সুবিধা : পরিবহন সুবিধা কর্মীদের প্রেষণা দানের একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হিসেবে গণ্য করা হয়। কর্মীরা অধিকাংশই দূর হতে কার্যক্ষেত্রে আসা-যাওয়া করে। ফলে যাতায়াতে তাদের সমস্যায় পড়তে হয়। এ সমস্যার জন্য কর্মীদের বিনামূল্যে পরিবহন ও যাতায়াত সুবিধা দেওয়া হয়। এতে কর্মীদের সময় ও অর্থের সাশ্রয় হয়।
৭. পদোন্নতি : কর্মীর পদোন্নতির ফলে দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব বৃদ্ধির সাথে সাথে আর্থিক সুবিধা বৃদ্ধি পায়। কর্মীর মেধা ও দক্ষতার ভিত্তিতে পদোন্নতি প্রদান করে প্রেষণা দান করা যায়। পদোন্নতি প্রেষণার একটি অন্যতম হাতিয়ার। পদোন্নতির মাধ্যমে প্রেষণাদান পদ্ধতি ব্যবস্থাপকদের জন্য অধিক কার্যকর।
৮. অন্যান্য সুবিধা : উল্লিখিত সুবিধাদি ছাড়াও আরও রয়েছে
- পুরস্কার (Reward)
- বিনোদন ভাতা (Recreation facilities)
- বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি (Increment)
- শিক্ষার ব্যবস্থা (Education facility)
- অগ্রিম বা ঋণ সুবিধা (Advance or Loan facility)
- আর্থিক নিরাপত্তা (Financial security)
- কল্যাণ তহবিল,
- অবসরকালীন সুযোগ-সুবিধা,
- কেন্টিন সুবিধা,
- ওভারটাইম,
- গৃহ নির্মাণ ঋণ,
- রেশন সুবিধা,
- শিক্ষা ভাতা প্রভৃতি ।
এসব সুবিধা প্রদান করলে কর্মীরা কাজে উৎসাহ বোধ করবে।
প্রেষণা দানের অনার্থিক উপায়
আর্থিক প্রেষণা ছাড়াও এমন অনেক অনার্থিক উপায় রয়েছে যেগুলো কর্মীদের প্রেষণা বৃদ্ধি করে। নিচে প্রেষণার অনার্থিক উপায় বা পদ্ধতিগুলো আলোচনা করা হলো:
১. কাজের স্বীকৃতি : প্রত্যেক মানুষ ভালো কাজের স্বীকৃতি প্রত্যাশা করে। কর্মীদের প্রেষণাদানের ক্ষেত্রে কাজের স্বীকৃতি প্রদান একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায় হিসেবে বিবেচনা করা যায়।
২. সুবিচার প্রতিষ্ঠা : কর্মীরা কর্তৃপক্ষের নিকট হতে ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করে। প্রতিষ্ঠানের সকল স্তরে ও সকল কাজে যদি সুবিচার প্রতিষ্ঠা করা যায় তবে তা কর্মীদের আকর্ষণ সৃষ্টি করবে।
৩. প্রতিষ্ঠানের সুনাম : একজন কর্মীর সামাজিক মর্যাদা তার কর্মক্ষেত্রের ওপর অনেকাংশে নির্ভর করে। প্রত্যেক কর্মী চায় একটি ভালো প্রতিষ্ঠানে এবং পদে কাজ করতে যা তার সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি করে। কর্মী যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করে তার সুনাম-সুখ্যাতিও কর্মীদের মাঝে প্রেরণা যোগায়।
৪. সুন্দর পরিবেশ : কাজের পরিবেশ সুন্দর ও স্বাস্থ্যকর হলে কর্মীরা কাজ করতে উৎসাহ পায়। সুষ্ঠু পরিবেশে কর্মীরা মনোযোগ সহকারে কাজ করতে পারে।
৫. প্রশিক্ষণ : প্রশিক্ষণ কর্মীর দক্ষতা ও মনোবল বাড়ায়। তাই প্রশিক্ষণ সুবিধাপ্রাপ্তির আশায়ও কর্মীরা প্রতিষ্ঠানে কাজ করে। এ সুবিধা কর্মীকে প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে উৎসাহিত করে।
৬. সুদক্ষ তত্ত্বাবধান : দক্ষ নির্বাহীর অধীনে কাজ করতে সবাই পছন্দ করে। ভালো তত্ত্বাবধায়কের অধীনে কর্মীরা স্বাচ্ছন্দ্যে কাজ করে। দক্ষ তত্ত্বাবধানে কোনো অর্থ ব্যয় না হলেও কর্মীদের প্রেষণা দানে এটি খুবই কার্যকর।
৭. উত্তম ব্যবহার : প্রতিটি কর্মীই তার নির্বাহিগণের নিকট থেকে উত্তম আচরণ প্রত্যাশা করে। প্রতিষ্ঠানের নির্বাহিগণের উত্তম আচরণ দ্বারা কর্মীদের কাজে প্রণোদনা দিতে পারে।
৮. অন্যান্য উপায় :
- চাকরির নিরাপত্তা
- প্রতিযোগিতা ও সৃজনশীলতা বিকাশের সুযোগ
- পেশাগত উন্নয়ন
- মত প্রকাশের স্বাধীনতা
- ব্যক্তিগত ক্ষমতা প্রদান
- সৌহার্দ্যমূলক সম্পর্ক
- বিনোদন ও বিশ্রামের সুযোগ
- পদ পরিবর্তন
- শুদ্ধ পদোন্নতি
পরিশেষে বলা যায়, প্রেষণাদানের যেসব প্রক্রিয়া অবলম্বন করে কর্মীদের উৎসাহদানের মাধ্যমে সহজেই কাজ আদায় করা যায় প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য অর্জনে ব্যবস্থাপককে সেগুলোই প্রয়োগ করা উচিত।