স্বাধীনতা অর্থ কি ?
স্বাধীনতার ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘Liberty’। ল্যাটিন শব্দ ‘Liber’ থেকে ইংরেজি ‘Liberty’ শব্দের উৎপত্তি। ‘Liber’ শব্দের অর্থ স্বাধীন বা মুক্ত। সুতরাং ‘Liberty’ এর ব্যুৎপত্তিগত অর্থ দাঁড়ায় স্ব-অধীনতা, নিজের অধীনতা বা সকল প্রকার বন্ধনমুক্ত অবস্থায় যা খুশি তাই করা। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বা আধুনিক সভ্য সমাজে স্বাধীনতার একটি বিশেষ অর্থ আছে। নিজের ইচ্ছেমতো, যা খুশি তাই করা স্বাধীনতা নয়। স্বাধীনতা হলো অন্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ না করে নিজের ইচ্ছেমতো কাজ করার অধিকার।
স্বাধীনতা বলতে কি বোঝায় ? / স্বাধীনতা কাকে বলে ?
অন্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ না করে নিজের ইচ্ছেমতো কাজ করার অধিকারকে স্বাধীনতা বলে । স্বাধীনতার অর্থ নিয়ন্ত্রিত অধিকার। প্রত্যেকে প্রত্যেকের অধিকার রক্ষার মধ্যে স্বাধীনতার তাৎপর্য নিহিত।
স্বাধীনতার সংজ্ঞা – মনীষিগন স্বাধীনতার সংজ্ঞা বিভিন্নভাবে দিয়েছেন-
অধ্যাপক লাস্কি (Prol. H. J. Laski)-এর মতে, “যে অনুকূল পরিবেশে মানুষ তার জীবনের চরম ও পরম বিকাশ সাধনের পূর্ণ সুযোগ লাভ করতে পারে তার আগ্রহ সংরক্ষণকে আমি স্বাধীনতা বলি।” (“By liberty I mean the eager maintenance of the atmosphere in which men have opportunity to be their best self.”)
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সিলী (Shelly) বলেছেন, “অতি শাসনের বিপরীত ব্যবস্থাই হলো স্বাধীনতা” (“Liberty is the opposite of ever Government.”)
হার্বার্ট স্পেশার (Herbert Spencer) বলেন, “স্বাধীনতা বলতে খুশিমতো কাজ করাকে বোঝায়। যদি উক্ত কাজের দ্বারা অপরের অনুরূপ কাজ করার অধিকার বিনষ্ট না হয়।
জন স্টুয়ার্ট মিল (John Stuart Mill) তার বিখ্যাত ‘Essay on Liberty’ গ্রন্থে বলেন, “মানুষের মৌলিক শক্তির বলিষ্ঠ, অব্যাহত ও বিভিন্নমুখী প্রকাশই স্বাধীনতা।” তিনি আরও বলেন, “ব্যক্তি তার নিজের ওপর, নিজের মন ও দেহের ওপর সম্পূর্ণ সার্বভৌম।”
উপরের সংজ্ঞাগুলো বিশ্লেষণ করলে প্রতীয়মান হয় যে, ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার মাধ্যমে তৈরি অনুকূল পরিবেশই স্বাধীনতা, যা ব্যক্তি অন্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ না করে ইচ্ছেমতো উপভোগ করতে পারে। স্বাধীনতার অর্থ নিয়ন্ত্রিত অধিকার। প্রত্যেকে প্রত্যেকের অধিকার রক্ষার মধ্যে স্বাধীনতার তাৎপর্য নিহিত। আশা করি স্বাধীনতা বলতে কি বোঝায় তা ভালো ভাবে বুঝতে পেরেছি ।
স্বাধীনতার শ্রেণিবিভাগ
রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা নাগরিকদের স্বাধীনতা সম্পর্কে আলোকপাত করতে গিয়ে সাত প্রকার স্বাধীনতার উল্লেখ করেছেন যা নিম্নে ছকের সাহায্যে দেখানো হলো।
- প্রাকৃতিক স্বাধীনতা
- আইনগত স্বাধীনতা
- সামাজিক স্বাধীনতা
- রাজনৈতিক স্বাধীনতা
- ব্যক্তিগত স্বাধীনতা
- অর্থনৈতিক স্বাধীনতা
- জাতীয় স্বাধীনতা
১. প্রাকৃতিক স্বাধীনতা (Natural liberty)
সামাজিক চুক্তিবাদী দার্শনিক হবস, সক এবং রুশো বিশ্বাস করতেন, রাষ্ট্র পূর্বাবস্থায় প্রকৃতির রাজ্যে (State of Nature) মানুষ কতকগুলো সুযোগ-সুবিধা বা স্বাধীনতা ভোগ করত। কিন্তু স্বাধীনতার এরকম ধারণা অলীক, অসার ও অবাস্তব বলেই প্রতিপন্ন হয়। কারণ অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মনে করেন, রাষ্ট্র এবং আইনের অনুপস্থিতিতে স্বাধীনতার অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। এ প্রসঙ্গে জন লক (John Locke) বলেন, “Where there is no law, there is no freedom” অর্থাৎ, যেখানে আইন নেই, সেখানে স্বাধীনতার অস্তিত্ব থাকতে পারে না। দার্শনিক রুশো তাঁর বক্তব্যে তাই স্বাধীনতাকে চমৎকারভাবে বর্ণনা করে বলেছেন, ‘মানুষ স্বাধীন হয়ে জন্মায়, কিন্তু সর্বত্রই যে শৃঙ্খলাবদ্ধ।” (“Man is born free but everywhere he is in chain.”)
২. আইনগত স্বাধীনতা (Legal liberty)
রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত, সংরক্ষিত ও নিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতাকে আইনগত স্বাধীনতা বলে। রাষ্ট্রের সংবিধান ও আইনে এ ধরনের স্বাধীনতার কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়। ব্যক্তি কল্যাণের স্বার্থে রাষ্ট্র আইনের মাধামে আইনগত স্বাধীনতা প্রদান করে থাকে। আইনগত স্বাধীনতা সুনির্দিষ্ট এবং আইন দ্বারা পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়।
৩. সামাজিক স্বাধীনতা (Civil liberty):
সামাজিক স্বাধীনতা বলতে অনেকেই Rule of Law-তথা আইনের শাসনকে বুঝিয়েছেন। অর্থাৎ মানুষ সমাজের সুসভ্য সদস্য হিসেবে যেসব সুযোগ-সুবিধার প্রয়োজন অনুভব করে সেগুলোকে সামাজিক স্বাধীনতা বলে। যেমন- জীবন রক্ষার স্বাধীনতা, সম্পত্তি রক্ষার স্বাধীনতা, ধর্মচর্চার স্বাধীনতা ও অবাধে চলাফেরা করার স্বাধীনতা। বস্তুত, সামাজিক ধারণা থেকে সামাজিক স্বাধীনতা উদ্ভূত এবং এ স্বাধীনতা এমনভাবে ভোগ করতে হয় যাতে অন্যের অনুরূপ স্বাধীনতা ক্ষুন্ন না হয়।
৪. রাজনৈতিক স্বাধীনতা (Political liberty)
রাজনৈতিক স্বাধীনতা বলতে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যক্তির অংশগ্রহণের ক্ষমতা বা পরিবেশকে বোঝায়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী লাঙ্কিও রাজনৈতিক স্বাধীনতা বলতে বাস্ত্রীয় কর্মকাণ্ডে ব্যক্তির অংশগ্রহণকে বুঝিয়েছেন। আবার, অধ্যাপক লীকক (Prof. Leacock)-এর মতে, “Political liberty es Constitutional liberty.” গিলক্রিস্টসহ অনেকেই রাজনৈতিক স্বাধীনতাকে গণতন্ত্রের সমার্থবোধক বনে উল্লেখ করেছেন। ভোটাধিকার, সরকারের সমালোচনা করা, সরকারি চাকরি লাভ প্রভৃতি রাজনৈতিক স্বাধীনতার অন্তর্ভুক্ত।
৫. ব্যক্তিগত স্বাধীনতা (Personal liberty)
ব্যক্তিগত স্বাধীনতা হলো সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তির এমন স্বাধীনতা যেগুলো ব্যক্তির একান্তই নিজের, যার প্রতি অন্য কেউ কোনোরূপ হস্তক্ষেপ (interfere) করতে পারে না। যেমন- খাদ্য, বস্ত্র, উন্নত জীবনযাপন, বিবাহ, সন্তান-সন্ততির শিক্ষা ইত্যাদি এ শ্রেণির পর্যায়ভুক্ত।
৬. অর্থনৈতিক স্বাধীনতা (Economic liberty)
অর্থনৈতিক কার্যাদির ব্যাপারে জনগণের স্বাধীনতাকে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বুঝানো হয়। অধ্যাপক এইচ. জে. লাস্কি (H. J. Laski) তাঁর ‘A Grammar of Politics’ গ্রন্থে বলেন, “অর্থনৈতিক স্বাধীনতা প্রতিনিয়ত বেকারত্বের আশংকা ও আগামীকালের অভাব থেকে মুক্তি এবং দৈনন্দিন জীবিকার্জনের সুযোগ- সুবিধাকে বোঝায়।” (“By economic liberty, I mean, security and the opportunity to find reasonable significance in the earning of one’s daily bread, against the wants tomorrow”)
৭. জাতীয় স্বাধীনতা (National liberty)
বৈদেশিক অধীনতা থেকে মুক্তি লাভ করে যখন একটি জাতি পূর্ণ সার্বভৌমত্ব লাভ করে তখন তাকে জাতীয় স্বাধীনতা বলে। অর্থাৎ কোনো জাতি বা দেশ যখন অন্য কোনো দেশের পরাধীনতা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে সার্বভৌম ক্ষমতার প্রয়োগ ঘটাতে পারে তখনই সে জাতি বা রাষ্ট্রকে স্বাধীন বলা যায়। জাতীয় স্বাধীনতা সব ধরনের স্বাধীনতার ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।
তবে এসব স্বাধীনতা উপভোগের জন্য অবশ্যই অনুকূল পরিবেশ দরকার। সমাজে যদি বিশৃঙ্খলা, ভয়, ক্ষুধা, দারিদ্র্য, বেকারত্ব, সন্ত্রাস ইত্যাদি থাকে তাহলে কোনো স্বাধীনতাই অর্থবহ হয় না।
স্বাধীনতার রক্ষাকবচ
স্বাধীনতা ভোগ করায় চেয়ে স্বাধীনতা সংরক্ষণ করা কঠিন কাজ। অর্থাৎ স্বাধীনতার সংরক্ষণের বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। যা স্বাধীনতার রক্ষাকবচ নামে পরিচিত। এজন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানিগণ আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে স্বাধীনতা রক্ষার কতকগুলো রক্ষাকবচের উল্লেখ করেছেন। সেগুলো নিম্নরূপ-
১. আইন (Law): আইন স্বাধীনতার পূর্বশর্ত (Law is the precondition of liberty)। আইনের উপস্থিতিতেই স্বাধীনতা ভোগ করা সম্ভব হয়। আইনহীন সমাজে স্বাধীনতা স্বেচ্ছাচারিতায় পরিণত হয়। এ প্রসঙ্গে আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তাবিদ, জন লক (John Locke) বলেন, “যেখানে আইন নেই, সেখানে স্বাধীনতা থাকতে পারে না।” (Where there is no law, there is no liberty)। আইনের যৌক্তিক নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা উপভোগ অর্থবহ হয়ে ওঠে ।
২. মৌলিক অধিকার (Written fundamental rights): স্বাধীনতা রক্ষার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন দেশের সংবিধানে নাগরিকদের মৌলিক অধিকারসমূহ লিপিবদ্ধকরণ। কারণ মৌলিক অধিকার উপভোগের সুযোগ ব্যতীত নাগরিক জীবন পূর্ণতা পায় না। তাই সংবিধানে মৌলিক অধিকার সন্নিবেশিত হলে নাগরিকেরা তদসম্পর্কে সচেতন থাকে। মৌলিক অধিকার ভঙ্গের কারণে ভিকটিম সর্বোচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হয়ে ন্যায়বিচার লাভ করতে পারে।
৩. আইনের শাসন (Rule of law): আইনের শাসন স্বাধীনতার একটি গুরুত্বপূর্ণ রক্ষাকবচ। আইনের শাসনের অর্থ মূলত (ক) আইনের দৃষ্টিতে সকলেই সমান (খ) বিনা অপরাধে কাউকে গ্রেফতার করা যাবে না এবং (গ) বিনা বিচারে কাউকে আটক রাখা যাবে না। আইনের শাসন বলতে আইনের পরিপূর্ণ প্রাধানাকেই নির্দেশ করে- যেখানে শাসকমহল আইনের উর্ধ্বে উঠে কোনো কিছু করতে পারে না। অর্থাৎ রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে অতি নগণ্য ব্যক্তিটিও একই আইনের অধীন।
৪. গণতন্ত্র (Democracy): গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জনগণের মৌলিক অধিকার উপভোগের সর্বাধিক সুযোগ থাকে। গণতন্ত্র বলতে জনগণের প্রতিনিধিদের দ্বারা জনগণের পক্ষে পরিচালিত শাসনব্যবস্থাকে বোঝায়, যেখানে সকলের সমান অধিকারের নিশ্চয়তা বিধানের চেষ্টা করা হয়। গণতন্ত্রের মূল শ্লোগান “জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস।” শাসকগোষ্ঠী জনগণের ভোটাধিকার লাভ করে জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে। এরূপ সরকার সাধারণত জনস্বার্থবিরোধী কোনো কাজ করে না। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সম্ভাব্য জনমত যাচাই করা হয়। এতে জনমত (Public opinion)-এর প্রতিফলন ঘটে।
৫. ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি (Separation of power): ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ স্বাধীনতা সংরক্ষণের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা। এ নীতির মূলকথা হলো সরকারের আইন, শাসন ও বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ স্বাধীন ও স্বতন্ত্র থেকে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করবে। এক বিভাগ অন্য বিভাগের কাজে অহেতুক হস্তক্ষেপ করবে না বা প্রভাব বিস্তার করবে না। কারণ একই ব্যক্তির হাতে একাধিক বিভাগের ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হলে স্বৈরশাসনের সৃষ্টি হয়।
৬. সদাসতর্ক জনমত (Eternal public vigilance): আধুনিককালে স্বাধীনতার বলিষ্ঠ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রক্ষাকবচ হনো সদাসতর্ক জনমত। অধ্যাপক লাঙ্কি (Prof. H. J. Laski) বলেন, “চিরন্তন সতর্কতার মধ্যেই স্বাধীনতার মূল্য নিহিত।” (“Eternal vigilance is the price of liberty”) নাগরিকদের উচিত স্বাধীনতা বিঘ্নকারীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা এবং চরম ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকা। এ প্রসঙ্গে হেনরি দেভিনশন যথার্থই বলেন, “স্বাধীনতার সংগ্রাম কোনোদিন শেষ হয় না কিংবা এর সংগ্রামক্ষেত্র কোনোদিন নীরব হয় না।”
৭. স্বাধীন বিচার বিভাগ (Independent Judiciary): স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগ নাগরিক অধিকার রক্ষার অন্যতম রক্ষাকবচ। ব্যক্তিস্বাধীনভার স্বার্থে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা একান্ত আবশ্যক। কারণ বিচার বিভাগ স্বাধীন, স্বতন্ত্র ও নিরপেক্ষ থাকলে কোনো নাগরিকের অধিকার ভঙ্গ হলে সর্বোচ্চে আদালত তা প্রতিকারের ব্যবস্থা নিতে পারে এবং ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি অধিকতর ন্যায়বিচার লাভ করতে পারে।
৮. দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থা (Responsible Government): স্বাধীনতা রক্ষার জন্য জনগণের সরকারকে অবশ্যই দায়িত্বশীল হতে হবে। সরকারের দায়িত্বশীলতা দুভাবে নিশ্চিত করা যায়। এক, জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি দ্বারা গঠিত আইনসভা জনগণের কাছে দায়িত্বশীল থাকবে। দুই, নির্বাচিত আইনসভার সদস্য নিয়ে গঠিত মন্ত্রিসভা বা শাসন বিভাগ তাদের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের জন্য আইনসভার কাছে এবং জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকবে। এরূপ দায়িত্বশীলতা বা জবাবদিহিতার বাধ্যবাধকতা থাকলে নাগরিকের স্বাধীনতা অধিকতর রক্ষা পাবে।
৯. ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ (Decentralisation of Power): স্বাধীনতা সংরক্ষণের জন্য ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ প্রয়োজন। কারণ একটিমাত্র কেন্দ্রের হাতে সকল ক্ষমতা কুক্ষিগত হলে একদিকে শাসনব্যবস্থায় স্থবিরতা আসে এবং অন্যদিকে শাসক স্বৈরাচারিতার পথে অগ্রসর হওয়ার সুযোগ পায়। এজন্য তৃণমূল পর্যায়ে ক্ষমতার অবাধ প্রবাহ প্রয়োজন।
১০. সরকার ও জনগণের মধ্যে সহযোগিতা (Cooperation between Government and people): সরকার ও জনগণের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতাও স্বাধীনতা রক্ষার জন্য অপরিহার্য শর্ত হিসেবে বিবেচ্য। কারণ বিরোধিতা শুধু গধ্বংস ডেকে আনে। আর বিপরীতে মধুর সম্পর্কের সমৃদ্ধি বয়ে আনে। এজন্য সরকার যদি জনগণের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয় এবং জনগণ যদি সরকারের প্রতি আনুগত্যশীল হয় তাহলে স্বাধীনতা রক্ষিত হবে।
১১. প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক পদ্ধতি (Direct democratic system): গণ ভোট, গণ উদ্যোগ, পদচ্যুতির মতো প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিসমূহ স্বাধীনতার অন্যতম রক্ষাকবচ। প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিসমূহের প্রয়োগ করে জনগণ শাসকদের স্বৈরাচারী কর্মকান্ড প্রতিরোধ করে নিজেদের স্বাধীনতা ও অধিকার সংরক্ষণ করতে পারে। এভাবে নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধি পায় এবং শাসকবর্গ জনগণের স্বাধীনতা রক্ষায় সচেষ্ট থাকে।
১২. বিশেষ সুযোগ-সুবিধার বিলোপ (Abolition of special facilities): অনেক সময় রাষ্ট্রের মধ্যে সরকারের যোগসাজশে বিশেষ মহলের জন্য বিশেষ সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা হয়। এতে সাধারণ নাগরিকদের অধিকার ক্ষুন্ন হয়। সুতরাং নাগরিক স্বাধীনতা রক্ষার জন্য এরূপ সুযোগ-সুবিধা বিলোপ করতে হবে।
১৩. সামাজিক ন্যায়বিচার (Social justice): সামাজিক ন্যায়বিচার গণতান্তিক সমাজ ব্যবস্থায় স্বাধীনতার অন্যতম রক্ষাকবচ হিসেবে স্বীকৃত। সামাজিক ন্যায়বিচার হলো রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে সকল মানুষের সমানভাবে সামাজিক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করার অধিকার বা পরিবেশ নিশ্চিত করা। সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হলে স্বাধীনতা রক্ষিত হয়। সামাজিক ন্যায়বিচার গণতন্ত্রের অন্যতম ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।
আরও পড়ুন >>> সাম্য কি ? সাম্যের ৭ টি শ্রেণিবিভাগ, গুরুত্ব, স্বাধীনতা ও সাম্যের সম্পর্ক !
কিছু গুরুত্বপুর্ন প্রশ্ন ও উত্তর
স্বাধীনতা বলতে কি বোঝায় ?
উত্তর: অন্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ না করে নিজের ইচ্ছেমতো কাজ করার অধিকারকে স্বাধীনতা বলে।
স্বাধীনতা কি ? / স্বাধীনতা কাকে বলে ? / স্বাধীনতা বলতে কি বুঝ ? /
উত্তর: অন্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ না করে নিজের ইচ্ছেমতো কাজ করার অধিকারকে স্বাধীনতা বলে।
স্বাধীনতার সংজ্ঞা দাও ?
উত্তর: অন্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ না করে নিজের ইচ্ছেমতো কাজ করার অধিকারকে স্বাধীনতা বলে।
স্বাধীনতা অর্থ কি ?
উত্তর: স্বাধীনতা অর্থ নিজের ইচ্ছেমত কাজ করার অধিকার।
স্বাধীনতা কি ও কেন ?
উত্তর: অন্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ না করে নিজের ইচ্ছেমতো কাজ করার অধিকারকে স্বাধীনতা বলে। স্বাধীনতা না থাকলে মানুষ স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠত আর স্বেচ্ছাচারীতা ভালো কিছু বয়ে আনে না ।
রাজনৈতিক স্বাধীনতা বলতে কি বুঝায় ?
উত্তর: রাজনৈতিক স্বাধীনতা বলতে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যক্তির অংশগ্রহণের ক্ষমতা বা পরিবেশকে বোঝায়।
কত তারিখে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয় ?
উত্তর: ১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়।
অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বলতে কি বোঝায় ?
উত্তর: অর্থনৈতিক কার্যাদির ব্যাপারে জনগণের স্বাধীনতাকে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বুঝানো হয়।
প্রাকৃতিক স্বাধীনতা বলতে কি বোঝায় ?
প্রকৃতির রাজ্যে (State of Nature) মানুষ কতকগুলো সুযোগ-সুবিধা বা স্বাধীনতা ভোগ করে তাকে প্রাকৃতিক স্বাধীনতা বলে।
সামাজিক স্বাধীনতা বলতে কি বোঝায় ?
মানুষ সমাজের সুসভ্য সদস্য হিসেবে যেসব সুযোগ-সুবিধার প্রয়োজন অনুভব করে সেগুলোকে সামাজিক স্বাধীনতা বলে। যেমন- জীবন রক্ষার স্বাধীনতা, সম্পত্তি রক্ষার স্বাধীনতা, ধর্মচর্চার স্বাধীনতা ও অবাধে চলাফেরা করার স্বাধীনতা।
ব্যক্তিগত স্বাধীনতা বলতে কি বোঝায় ?
ব্যক্তিগত স্বাধীনতা হলো সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তির এমন স্বাধীনতা যেগুলো ব্যক্তির একান্তই নিজের, যার প্রতি অন্য কেউ কোনোরূপ হস্তক্ষেপ (interfere) করতে পারে না। যেমন- খাদ্য, বস্ত্র, উন্নত জীবনযাপন, বিবাহ, সন্তান-সন্ততির শিক্ষা ইত্যাদি