বিভিন্ন প্রকার প্রশিক্ষণের পদ্ধতি বা প্রশিক্ষণের প্রকারভেদ !
একজন কর্মী জন্মগতভাবে বিভিন্ন গুণের অধিকারী হতে পারে তবে কার্যক্ষেত্রে তার দক্ষতা ও পারদর্শিতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণের পদ্ধতি প্রয়োজন হয়। প্রতিষ্ঠান তার সকল শ্রেণির কর্মীর জন্য একই ধরনের প্রশিক্ষণ পদ্ধতি ব্যবহার করে না। বিভিন্ন শ্রেণির কর্মী ও ব্যবস্থাপকগণকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতির প্রয়োজন হয়। বস্তুত প্রতিষ্ঠানে দু’ধরনের প্রশিক্ষণের পদ্ধতি প্রচলিত । নিচে প্রশিক্ষণের প্রকারভেদ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:
ক. কাজের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ (On-the-job training)
যে প্রশিক্ষণ পদ্ধতিতে একজন কর্মী কাজে জড়িত থেকে কাজ সম্পর্কে বাস্তব ও হাতেনাতে দক্ষতা অর্জন করে তাকে কাজের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ বলে।
খ. কাজের বাইরে প্রশিক্ষণ (Off-the-job training)
যে প্রশিক্ষণ পদ্ধতিতে একজন নির্বাহীকে প্রতিষ্ঠানের বাইরে সুন্দর ও নিরিবিলি পরিবেশে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় তাকে কাজের বাইরে প্রশিক্ষণ পদ্ধতি বলে।
আরও পড়ুন >>> প্রশিক্ষণের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা !
আসুন এখন এই প্রশিক্ষণের পদ্ধতি গুলো নিয়ে আলোচনা করে বোঝার চেষ্টা করি এগুলো কিভাবে করা হয় –
কাজের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ (On-the-job training)
১. শিক্ষানবিশ প্রশিক্ষণ (Apprenticeship)
কোনো অভিজ্ঞ তত্ত্বাবধায়কের অধীনে কতিপয় কর্মীকে নির্দিষ্ট মেয়াদে কার্যক্ষেত্রে হাতেকলমে ও তাত্ত্বিক বিষয়ে যে জ্ঞান দেওয়া হয় তাকে শিক্ষানবিশ প্রশিক্ষণ বলে। এ ধরনের প্রশিক্ষণ পদ্ধতিতে কর্মীকে নির্দিষ্ট কাজে চূড়ান্তভাবে নিয়োগের পূর্বে তাকে ঐ কাজের বিভিন্ন বিষয়ে হাতেকলমে শিক্ষা দেওয়া হয়। অতঃপর শিক্ষানবিশ প্রশিক্ষণ শেষে কর্মীকে চূড়ান্তভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়। উদাহরণস্বরূপ: কোনো একটি প্রতিষ্ঠানে অস্থায়িভাবে কিছু কর্মী নিয়োগের পর ৬ মাসের প্রশিক্ষণ শেষে যোগ্যতাসম্পন্ন কর্মীকে স্থায়ী নিয়োগদান।
২. পদ পরিবর্তন (Job rotation)
যে প্রশিক্ষণ পদ্ধতিতে কর্মীকে একই প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পদে দায়িত্ব প্রদানের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় তাকে পদ পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ বলে। অর্থাৎ এ পদ্ধতিতে প্রতিষ্ঠানের কর্মীদেরকে এক পদ হতে অন্য পদে বদলি করে সকল কাজের জন্য উপযুক্ত করে গড়ে তোলা হয়। এতে কর্মীর মধ্যে প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন কাজে দক্ষতা, অভিজ্ঞতা, জ্ঞান ইত্যাদি অর্জিত হয়। আমাদের দেশের ব্যাংকসমূহ ও মন্ত্রণালয়সমূহে পদ পরিবর্তন পদ্ধতিতে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
৩. প্রবেশনা পদ্ধতি (Internship)
যে প্রশিক্ষণ পদ্ধতিতে নির্ধারিত শিক্ষায়তনে একটি নির্দিষ্ট শিক্ষা কোর্সে প্রার্থীদেরকে ভর্তি করে তাদেরকে তত্ত্বমূলক জ্ঞান দান করা হয় এবং মাঝে মাঝে তাদেরকে কোনো ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে নিয়ে ঐ সম্পর্কে বাস্তব জ্ঞান দেওয়া হয় তাকে প্রশিক্ষণের প্রবেশনা পদ্ধতি বলে। এ ধরনের প্রশিক্ষণ পদ্ধতির মাধ্যমে শিক্ষার্থী তত্ত্ব ও প্রয়োগ উভয় প্রকার জ্ঞান অর্জন করতে পারে। আমাদের দেশের BBA, MBA ও নার্স ডিগ্রিধারীদের এ ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। একজন উচ্চ পর্যায়ের নির্বাহী যা বিশেষ অধীনে রেখে ও ধরনের প্রশিক্ষণ প্রদান করা উত্তম।
৪. কোচিং (Coaching)
যে প্রশিক্ষণ পদ্ধতিতে শিক্ষানবিশ কর্মিগণ একজন তত্ত্বাবধায়ক সুপারভাইজর কোচের অধীনে থেকে কাজের পদ্ধতি ও কৌশল সম্পর্কে ব্যবহারিক জ্ঞান অর্জন করে তাকে প্রশিক্ষণের কোচিং পদ্ধতি বলে। এ ধরনের প্রশিক্ষণ পদ্ধতিতে প্রশিক্ষণার্থীদেরকে বিভিন্ন দলে ভাগ করে এক একজন প্রশিক্ষকের অধীনে এক একটি দল রাখা হয়। আমাদের দেশের খেলাধুলার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের এ ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
৫. পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি (Observation method)
যে প্রশিক্ষণ পদ্ধতিতে একজন নির্বাহী খুব কাছে থেকে কর্মীদের কাজ দেখেন এবং ভুল-ত্রুটি হলে তা সংশোধনের ব্যবস্থা করে দেন তাকে প্রশিক্ষণের পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি বলে। এ ধরনের প্রশিক্ষণ পদ্ধতি অনেকটা শিক্ষানবিশ প্রশিক্ষণ পদ্ধতির মতোই। পর্যবেক্ষণ। পদ্ধতির প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষণ গ্রহীতাকে একজন অভিজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞ নির্বাহীর অধীনে নিযুক্ত করা হয়। প্রশিক্ষণ গ্রহণকারী নির্বাহীর কার্যসম্পাদন প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করে এবং তার নির্দেশ ও পরামর্শ অনুযায়ী চলে।
কাজের বাইরে প্রশিক্ষণ (Off-the-job training)
১. বক্তৃতা পদ্ধতি (Lecture method)
যে প্রশিক্ষণ পদ্ধতিতে প্রশিক্ষণার্থীদেরকে একত্রিত করে কোনো বিশেষজ্ঞ প্রশিক্ষক কোনো বিষয় সম্পর্কে বক্তৃতা প্রদানের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন তাকে প্রশিক্ষণের বক্তৃতা পদ্ধতি বলে। এটি সুপ্রাচীন ও বহুল প্রচলিত প্রশিক্ষণ পদ্ধতি। এ পদ্ধতির মাধ্যমে প্রশিক্ষণার্থীদেরকে প্রতিষ্ঠান বা কোনো বিষয় সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়।
২. আলোচনা পদ্ধতি (Discussion method)
একটি নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট স্থানে পূর্বনির্ধারিত বিষয় নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সাথে আলাপ- আলোচনার প্রশিক্ষণ পদ্ধতিকে আলোচনা পদ্ধতি বলে। এ ধরনের প্রশিক্ষণ পদ্ধতিতে একজন দলনেতা থাকেন যিনি এক বা একাধিক সমস্যার বিশদ বর্ণনা, উপদেশ, দিকনির্দেশনা এবং ফলাফলের উপর পর্যালোচনা করে থাকেন।
৩. সেমিনার (Seminar)
যে প্রশিক্ষণ পদ্ধতিতে একটা বিষয় নিয়ে এক বা একাধিক অধিবেশনে বসে প্রশিক্ষণার্থীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় তাকে প্রশিক্ষণের সেমিনার পদ্ধতি বলে। কয়েকটি সেশনের প্রত্যেকটিকে এক বা একাধিক বিষয়ভিত্তিক প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হয়। প্রবন্ধের ওপর প্রশিক্ষণার্থীদের মতামত গ্রহণ করা হয়। সভাশেষে সভার সভাপতির সব বক্তব্যের একটি সারমর্ম উপস্থাপন করা হয়।
৪. অধিবেশন (Conference)
যে প্রশিক্ষণ পদ্ধতিতে একটা অধিবেশনে বসে প্রশিক্ষণার্থীদের পূর্ব নির্ধারিত কোনো বিষয় নিয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় তাকে প্রশিক্ষণের অধিবেশন পদ্ধতি বলে। অধিবেশন কর্মসূচি অভ্যন্তরীণ অথবা বাহ্যিক দুই ধরনেরই হতে পারে। এ ব্যবস্থায় দক্ষ ও বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিগণ বিভিন্ন বিষয়ে সারগর্ভ আলোচনা করেন এবং প্রশিক্ষণার্থীদের তাত্ত্বিক জ্ঞান দান করেন। সুপারভাইজর এবং মধ্যম পর্যায়ের ব্যবস্থাপকদের জন্য এই পদ্ধতি উত্তম। উনে
৫. ঘটনা পদ্ধতি (Incident method)
এ ধরনের প্রশিক্ষণ পদ্ধতিতে প্রশিক্ষণ গ্রহীতাগণকে কোনো একটি বিশেষ ঘটনা বা সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রশিক্ষণার্থিগণ উক্ত ঘটনা সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ ও পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের বাস্তব জ্ঞান আহরণ করে থাকে।
৬. ওয়ার্কশপ (Workshop)
সাধারণত নিম্নস্তরের প্রশিক্ষণার্থীদের হাতেকলমে জ্ঞানদানের জন্য ওয়ার্কশপ পদ্ধতির মাধ্যমে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। প্রশিক্ষণার্থিগণ ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে উপস্থাপিত বিষয় নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে এবং উক্ত বিষয়ে করণীয় কী তা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে বসেই নির্ণয় করতে পারে।
৭. টাস্কফোর্স (Taskforce)
জরুরি ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠানের কোনো বিশেষ সমস্যা সমাধানে গঠিত কমিটিকে টাস্কফোর্স বলে। এ পদ্ধতিতে কমিটির সদস্য প্রশিক্ষণার্থিগণ সমস্যার বাস্তব সমাধান বের করে নিজেরাই পরিস্থিতি সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে পারে।
৮. নাট্যাভিনয় কৌশল (Role playing method)
পদস্থ কর্মকর্তা ও কার্য নির্বাহীদের প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য নাট্যাভিনয় কৌশল ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এ পদ্ধতিতে প্রশিক্ষণার্থীরা কোনো বাস্তব সমস্যার অনুকরণে কৃত্রিম সমস্যার সৃষ্টি করে বিভিন্ন ভূমিকায় অভিনয় করে। প্রশিক্ষণার্থীদের মধ্যে কেউ কেউ পর্যবেক্ষকের ভূমিকা পালন করে। অভিনয় শেষে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হয়। এভাবে বাস্তর পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ অভিনয়ের মাধ্যমে প্রত্যেকে সমস্যার গভীরে প্রবেশ করতে পারে এবং সমাধানের বাস্তবসম্মত পন্থা খুঁজে বের করতে পারে।
৯. অনুভূতিপ্রবণ প্রশিক্ষণ (Sensitivity training)
যে প্রশিক্ষণ পদ্ধতিতে একাধিক প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন নির্বাহীদের মধ্যে বিভিন্ন আলোচনার মাধ্যমে নিজেদের মানবীয় আচরণ সম্পর্কে উপস্থাপন করে নিজস্ব মতামত তুলে ধরতে বলা হয় তাকে অনুভূতিপ্রবণ প্রশিক্ষণ বলে। এ ধরনের প্রশিক্ষণ পদ্ধতিতে কোনো ধরনের প্রশিক্ষক থাকে না। এক্ষেত্রে সমন্বয়ক বা মডারেটর হিসেবে ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ কাজ করে। উচ্চ পর্যায়ে অধিষ্ঠিত নির্বাহীদের অহংবোধ বা তাদের নিজেদের সম্পর্কে উচ্চ ধারণা দূর করতে এ ধরনের প্রশিক্ষণ পদ্ধতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
FAQs
বাস্তব প্রশিক্ষণ কি ?
বাস্তবে হাতে কলমে যখন কোন কাজ শেখানো হয় তাঁকে বাস্তব প্রশিক্ষণ বলে । বর্তমানে শিক্ষন কার্যক্রম আরও গতিশীল করতে আমরা বাস্তব প্রশিক্ষণের সাহায্য নিতে পারি ।
শিক্ষানবিশ কাকে বলে ?
কোনো অভিজ্ঞ তত্ত্বাবধায়কের অধীনে কতিপয় কর্মীকে নির্দিষ্ট মেয়াদে কার্যক্ষেত্রে হাতেকলমে ও তাত্ত্বিক বিষয়ে যে জ্ঞান দেওয়া হয় তাকে শিক্ষানবিশ প্রশিক্ষণ বলে।
অনলাইন প্রশিক্ষণ কি ?
কোভিড -১৯ এর জন্য সারা বিশ্ব যখন স্থবির তখনি এই অনলাইন প্রশিক্ষণের ধারণা প্রথম দেখা যায় । যখন প্রশিক্ষণ ফেস টু ফেস না হয়ে অনলাইন ভিডিও কনফারেন্সিং এপসের মাধ্যমে হয় তাঁকে অনলাইন প্রশিক্ষণ বলে । অনলাইনে বিভিন্ন এপস ব্যবহার করে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় যেমন – জুম, গুগল মিট, মাইক্রোসফট টিমস ইত্যাদি ।