জাবেদা শেখার সহজ উপায় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো আজকের এই পোস্টে । পুরো পোস্টটি পরলে জাবেদা পানির মত মনে হবে । জাবেদা শেখার সহজ উপায় হিসেবে ডেবিট ক্রেডিট নির্ণয়ের জন্য আমরা হিসাববিজ্ঞানের আধুনিক সুত্র ব্যবহার করবো। মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে আমাদের কিছু বিষয় সমর্কে জানা উচিত সেগুলো নিচে সংক্ষিপ্তভাবে আলোচনা করা হলো ।
জাবেদা শেখার সহজ উপায়
জাবেদা শেখার সহজ উপায় বলতে কিছু গ্রুত্বপূর্ণ ধাপ মাথায় রেখে কিছু রুলস মনে রাখা । সেই জন্য আমাদের নিচের বিষয়গুলো সম্পর্কে জানা উচিত এবং আয়ত্বে রাখা উচিত –
ঘটনা: কোন কিছু সংঘটিত হওয়াকে ঘটনা বলে। মানুষ তার জীবনকালে ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও অর্থনৈতিকভাবে যে সকল কর্মকাণ্ড ঘটাচ্ছে তার প্রত্যেকটি এক একটি ঘটনা। প্রতিদিন যে সকল ঘটনা ঘটছে তাকে দুইভাগে ভাগ করা যায় : (১) অনার্থিক ঘটনা ও (2) আর্থিক ঘটনা।
লেনদেন: লেনদেন বলতে আদান-প্রদানকে বুঝায়। কিন্তু ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে অর্থ বা অর্থের অংকে পরিমাপযোগ্য যাবতীয় অর্থনৈতিক কর্ম প্রক্রিয়া বা আদান-প্রদানই হলো লেনদেন। লেনদেনে সবসময় দুইটি পক্ষ (ডেবিট / ক্রেডিট) থাকে। এক পক্ষ প্রদান করে আরেক পক্ষ গ্রহণ করে। একে লেনদেনের দ্বৈতসত্তা বলে।
হিসাব: লেনদেনের দ্বৈতসত্তা অনুযায়ী লেনদেনের প্রতিটি পক্ষকে এক একটি হিসাব বলা হয়। যেমন- জসীম হিসাব, বেতন হিসাব, বিজ্ঞাপন খরচ হিসাব, আসবাবপত্র হিসাব ইত্যাদি ।
হিসাব সমীকরণ: কারবারে মোট সম্পত্তির সমপরিমাণ দায় থাকে। এটিই হিসাব সমীকরণ। মোট সম্পত্তি= মোট দায় + মালিকানা স্বত্ত । A=L+OE; A=Assets, L=Liabilities, OE=Owners Equity
জাবেদা: এই ব্যবসায়ের লেনদেনগুলোকে যে বই বা খাতাতে লিপিবদ্ধ করা হয় তাকে জাবেদা বলে। লেনদেন সংগঠিত হওয়ার সাথে সাথে ডেবিট ক্রেডিট নির্ণয়পূর্বক জাবেদায় লিপিবদ্ধ করতে হয় ।
জাবেদা সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন ।
ডেবিট ক্রেডিট নির্ণয় করার পদ্ধতি
ডেবিট ক্রেডিট নির্ণয়ের সূত্র: ডেবিট ক্রেডিট নির্ণয় করার পদ্ধতি দুই ধরনের-
১। সনাতন পদ্ধতি
২। আধুনিক পদ্ধতি
আমরা ডেবিট ক্রেডিট নির্ণয় করার জন্য হিসাববিজ্ঞানের আধুনিক সূত্র ব্যবহার করবো। কারণ আধুনিক পদ্ধতিতে ডেবিট ক্রেডিট নির্ণয় করা অপেক্ষাকৃত সহজ। তাহলে চলুন দেখে নেই কিভাবে আধুনিক পদ্ধতিতে লেনদেনের ডেবিট ক্রেডিট নির্ণয় করা যায়-
আধুনিক পদ্ধতিতে হিসাবকে আমরা মূলত তিন ভাগে ভাগ করতে পারি। সম্পত্তি, দায় ও মালিকানাস্বত্ত্ব
সম্পত্তি: সম্পত্তি সাধারণত ডেবিট ব্যালেন্স নির্দেশ করে ।
সম্পদ বৃদ্ধি পেলে ——– ডেবিট
সম্পদ হ্রাস পেলে ——–ক্রেডিট
দায়: দায় সাধারণত ক্রেডিট ব্যালেন্স নির্দেশ করে। প্রতিষ্ঠানে-
দায় হ্রাস পেলে ———- ডেবিট
দায় বৃদ্ধি পেলে ———- ক্রেডিট
মালিকানাস্বত্ত্ব: সাধারণত ক্রেডিট ব্যালেন্স নির্দেশ করে। প্রতিষ্ঠানে-
মালিকানাস্বত্ব হ্রাস পেলে —- ডেবিট
মালিকানাস্বত্ব বৃদ্ধি পেলে —- ক্রেডিট
মালিকানাস্বত্বকে আবার তিন ভাগে ভাগ করা যায়। আয়, ব্যয় ও উত্তোলন। প্রতিষ্ঠানে-
আয়: প্রতিষ্ঠানে-
আয় হ্রাস পেলে ———- ডেবিট
আয় বৃদ্ধি পেলে ———- ক্রেডিট
ব্যয়: প্রতিষ্ঠানে-
ব্যয় বৃদ্ধি পেলে ——– ডেবিট
ব্যয় হ্রাস পেলে ——–ক্রেডিট
উত্তোলন: প্রতিষ্ঠানে-
উত্তোলন হ্রাস পেলে ———- ডেবিট
উত্তোলন বৃদ্ধি পেলে ———- ক্রেডিট
উপরের এই সূত্রটি মনে রাখার জন্য আমরা এইভাবে মনে রাখতে পারি–
সম্পদ/ব্যয়/উত্তোলন বৃদ্ধি পেলে ডেবিট, কমলে ক্রেডিট
আয়/দায়/উত্তোলন কমলে ডেবিট, বৃদ্ধি পেলে ক্রেডিট
কিছু হিসাবের নাম
কিছু হিসাবের নাম মনে রাখলে ডেবিট ক্রেডিট নির্ণয় করতে সুবিধা হবে –
সম্পত্তি হিসাবঃ নগদান হিসাব, ব্যাংক হিসাব, আসবাবপত্র হিসাব, কলকব্জা ও যন্ত্রপাতি হিসাব, অফিস সরঞ্জাম হিসাব, দালানকোঠা হিসাব, বিনিয়োগ হিসাব, দেনাদার হিসাব, প্রাপ্য বিল হিসাব, সমাপনী মজুদ, অগ্রিম ব্যয় হিসাব, প্রাপ্য আয় হিসাব, অগ্রিম বীমা সেলামী হিসাব, সুনাম হিসাব, অগ্রিম ভাড়া হিসাব, প্রদত্ত ঋণ হিসাব, শেয়ার ক্রয় হিসাব, ইজারা সম্পত্তি হিসাব, প্রাথমিক খরচাবলি, মজুদ পণ্য হিসাব ইত্যাদি।
দায় হিসাবঃ ঋণ হিসাব, পাওনাদার হিসাব, প্রদেয় বিল হিসাব, অগ্রিম আয় হিসাব, বকেয় ব্যয় হিসাব, ব্যাংক জমাতিরিক্ত হিসাব প্রভৃতি।
স্বত্বাধিকার হিসাবঃ মুলধন হিসাব, উত্তোলন হিসাব, উত্তোলনের সুদ, আয়কর হিসাব, সাধারণ সঞ্চিতি হিসাব, অনাদায়ী পাওনা সঞ্চিতি হিসাব, মুলধনের সুদ প্রভৃতি।
আয় হিসাবঃ বিক্রয় হিসাব, প্রাপ্ত ভাড়া হিসাব, সুদ আয় হিসাব, প্রাপ্ত কমিশন হিসাব, প্রাপ্ত বাট্টা হিসাব, বিক্রয় ফেরত হিসাব, বিনিয়োগের সুদ ব্যয় হিসাবঃ ক্রয় হিসাব, পরিবহন
ব্যয় হিসাবঃ বিক্রয় পরিবহণ হিসাব, বেতন হিসাব, মজুরি হিসাব, ভাড়া হিসাব, মনিহারি হিসাব, বিজ্ঞাপন হিসাব, সুদ ব্যয় হিসাব, প্রদত্ত কমিশন হিসাব, প্রদত্ত বাট্টা হিসাব, অনাদায়ী পাওনা হিসাব, মেরামত হিসাব, অবচয় হিসাব, আমদানি শুল্ক হিসাব, ক্রয় ফেরত হিসাব প্রভৃতি।
ডেবিট ক্রেডিট নির্ণয়
এতক্ষণ আমরা ডেবিট-ক্রেডিট নির্ণয়ের সূত্র সম্পর্কে জানলাম, বিভিন্ন হিসাবের নামও জানলাম এখন চলুন দেখে নেই একটি লেনদেন থেকে কিভাবে ডেবিট-ক্রেডিট নির্ণয় করতে হয়।
১. ধরি, মিঃ ডাবলু ১,০০,০০০ টাকা দিয়ে একটি কম্পিউটার এর ব্যবসায় শুরু করলেন ।
ব্যাখ্যা: এখানে , ডাবলু ১ লক্ষ টাকা দিয়ে ব্যবসায় শুরু করার ফলে ব্যবসায়ে মূলধন নামক দায় বৃদ্ধি পেয়েছে তাই সূত্র অনুযায়ী দায় বৃদ্ধি পেলে হয় ক্রেঃ এবং নগদ টাকা ব্যবসায়ে যুক্ত হওয়ায় নগদান নামে সম্পদ বৃদ্ধি পেয়েছে তাই সূত্র অনুযায়ী সম্পদ বৃদ্ধি পেলে হয় ডেঃ। অতএব-
নগদান হিসাব (সম্পদ বৃদ্ধি) >> ডেঃ
মূলধন হিসাব (দায় বৃদ্ধি) >> ক্রেঃ
২. আসবাবপত্র ক্রয় করলেন ১০,০০০ টাকার।
ব্যাখ্যা: এখানে , আসবাবপত্র ক্রয়ের ফলে ব্যবসায়ে নতুন আসবাবপত্র যুক্ত হওয়ায় সম্পদ বৃদ্ধি পেয়েছে তাই সূত্র অনুযায়ী সম্পদ বৃদ্ধি পেলে হয় ডেঃ এবং যেহেতু নগদ টাকা দিয়ে আসবাবপত্র কেনা হলো তাই নগদ টাকার পরিমাণ ব্যবসায় থেকে কমে যাবে তাই সূত্র অনুযায়ী সম্পদ হ্রাস পেলে হয় ক্রেঃ। অতএব-
আসবাবপত্র হিসাব (সম্পদ বৃদ্ধি) >> ডেঃ
নগদান হিসাব (সম্পদ হ্রাস) >> ক্রেঃ
৩. দোকানের ভাড়া প্রদান করলেন ৩,০০০ টাকা।
ব্যাখ্যা: এখানে , দোকানের ভাড়া বাবদ ৩,০০০ টাকা প্রদান করায় ভাড়া নামক ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে তাই সূত্র অনুযায়ী ব্যয় বৃদ্ধি পেলে হয় ডেঃ এবং যেহেতু নগদ টাকা দিয়ে ভাড়া প্রদান করা হলো তাই নগদ টাকার পরিমাণ ব্যবসায় থেকে কমে যাবে তাই সূত্র অনুযায়ী সম্পদ হ্রাস পেলে হয় ক্রেঃ। অতএব-
ভাড়া হিসাব (ব্যয় বৃদ্ধি) >> ডেঃ
নগদান হিসাব (সম্পদ হ্রাস) >> ক্রেঃ
৪. পণ্য /কম্পিউটার (বিক্রয়ের জন্য) ক্রয় করলেন ৭০,০০০ টাকা।
ব্যাখ্যা: এখানে , দোকানে বিক্রয়ের জন্য কম্পিউটার ক্রয় করেছেন যার ফলে ক্রয় নামক ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে তাই সূত্র অনুযায়ী ব্যয় বৃদ্ধি পেলে হয় ডেঃ এবং যেহেতু নগদ টাকা দিয়ে পণ্য ক্রয় করা হলো তাই নগদ টাকার পরিমাণ ব্যবসায় থেকে কমে যাবে তাই সূত্র অনুযায়ী সম্পদ হ্রাস পেলে হয় ক্রেঃ। অতএব-
ক্রয় হিসাব (ব্যয় বৃদ্ধি) >> ডেঃ
নগদান হিসাব (সম্পদ হ্রাস) >> ক্রেঃ
৫. ধারে পণ্য ক্রয় করলেন ২,০০,০০০ টাকা।
ব্যাখ্যা: এখানে , দোকানে পণ্য ক্রয় করে টার টাকা প্রদান করা হয় নি, তাই ক্রয় নামক ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে তাই সূত্র অনুযায়ী ব্যয় বৃদ্ধি পেলে হয় ডেঃ এবং যেহেতু নগদ টাকা এখানে প্রদান না করে বাকিতে ক্রয় করা হয়েছে তাই পাওনাদার (যাকে টাকা প্রদান করতে হবে) নামক দায় বৃদ্ধি পাবে যাবে তাই সূত্র অনুযায়ী দায় বৃদ্ধি পেলে হয় ক্রেঃ। অতএব-
ক্রয় হিসাব (ব্যয় বৃদ্ধি) >> ডেঃ
পাওনাদার হিসাব (দায় বৃদ্ধি) >> ক্রেঃ
৬. নগদে পণ্য বিক্রয় করলেন ১,০০,০০০ টাকা।
ব্যাখ্যা: এখানে , দোকান হতে পণ্য বিক্রয় করে তার টাকা নগদে পাওয়া গিয়েছে, তাই বিক্রয় নামক আয় বৃদ্ধি পেয়েছে সুতরাং সূত্র অনুযায়ী আয় বৃদ্ধি পেলে হয় ক্রেঃ এবং যেহেতু নগদ টাকা এখানে পণ্য বিক্রয় করে পাওয়া গেছে, তাই সূত্র অনুযায়ী সম্পদ বৃদ্ধি পেলে হয় ডেঃ। অতএব-
নগদান হিসাব (সম্পদ বৃদ্ধি) >> ডেঃ
বিক্রয় হিসাব (আয় বৃদ্ধি) >> ক্রেঃ
৭. ধারে পণ্য বিক্রয় করলেন ২,০০,০০০ টাকা।
ব্যাখ্যা: এখানে , দোকান হতে পণ্য বিক্রয় করেছি কিন্তু তার টাকা নগদে পাওয়া যায় নি, তাই বিক্রয় নামক আয় বৃদ্ধি পেয়েছে সুতরাং সূত্র অনুযায়ী আয় বৃদ্ধি পেলে হয় ক্রেঃ এবং যেহেতু নগদ টাকা এখানে পাওয়া যায় নি বাকিতে বিক্রয়ের কারণে, তাই সূত্র অনুযায়ী সম্পদ বৃদ্ধি পেলে হয় ডেঃ। অতএব-
দেনাদার হিসাব (সম্পদ বৃদ্ধি) >> ডেঃ
বিক্রয় হিসাব (আয় বৃদ্ধি) >> ক্রেঃ
৮. পাওনাদারকে পরিশোধ করলেন ১,০০,০০০ টাকা।
ব্যাখ্যা: এখানে , পাওনাদারকে তার পাওনা পরিশোধ করা হয়েছে, তাই পাওনাদার নামক দায় কমে যাবে সুতরাং সূত্র অনুযায়ী দায় কমলে বা হ্রাস পেলে হয় ডেঃ এবং যেহেতু নগদ টাকা (সম্পদ) দিয়ে পাওনাটা পরিশোধ করা হয়েছে, তাই সূত্র অনুযায়ী সম্পদ হ্রাস পেলে হয় ক্রেঃ। অতএব-
পাওনাদার হিসাব (দায় হ্রাস) >> ডেঃ
নগদান হিসাব (সম্পদ হ্রাস) >> ক্রেঃ
৯. ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ব্যবসায় হতে নগদ টাকা নিলেন ১০,০০০ টাকা।
ব্যাখ্যা: এখানে , মালিক তার প্রয়োজনে ব্যবসায় হতে টাকা উত্তোলন করেছেন আর উত্তোলন করলে মালিকানাস্বত্ত্ব কমে যায়, তাই সূত্র অনুযায়ী মালিকানাস্বত্ত্ব কমলে বা হ্রাস পেলে হয় ডেঃ এবং যেহেতু নগদ টাকা (সম্পদ) মালিক ব্যবসায় থেকে নিয়ে গেছে, তাই সূত্র অনুযায়ী সম্পদ হ্রাস পেলে হয় ক্রেঃ। অতএব-
উত্তোলন হিসাব (মালিকানাস্বত্ত্ব হ্রাস) >> ডেঃ
নগদান হিসাব (সম্পদ হ্রাস) >> ক্রেঃ
জাবেদায় লিপিবদ্ধ করার জন্য একটি নির্দিষ্ট ছক আছে এখন উপরের লেনদেনগুলি জাবেদায় কিভাবে লিপিবদ্ধ করতে হয় –
জাবেদার উদাহরণ / হিসাববিজ্ঞান জাবেদা / হিসাব বিজ্ঞান জাবেদা
জাবেদা শেখার সহজ উপায় সম্পর্কিত এই পোস্টে আমরা এতক্ষণ দেখলাম কিভাবে জাবেদা করতে হয় । আর এগুলো মনে রাখতে হলে বেশি বেশি করে প্র্যাক্টিস করতে হবে । জাবেদা প্রশ্ন ও উত্তর নামক পোস্টে কিছু উদাহরণ দেওয়া হলো এগুলো ভালো করে অনুশীলন করলে জাবেদায় আর কোন প্রবলেম থাকবে না আশা করছি ।