অর্থনীতি হলো সীমিত সম্পদ ও অসীম অভাবের মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমে মানুষের কল্যাণ করা । মানুষের দৈনন্দিন জীবনে ও রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে এবং দেশের বিভিন্ন আর্থসামাজিক সমস্যা সমাধানে অর্থনীতি পাঠের গুরুত্ব অপরিসীম। তাই আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় ” অর্থনীতি পাঠের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা কর ”
অর্থনীতি পাঠের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা কর ।
আধুনিক সমাজে অর্থনীতি পাঠের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। কারণ বর্তমান সমাজের অধিকাংশ সমস্যা হলো অর্থনৈতিক সমস্যা। আর এসব সমস্যার সমাধান খুঁজে পাওয়া যায় অর্থনীতিতে। তাই সমাজবদ্ধ মানুষের সব অর্থনৈতিক কাজকর্ম অর্থনীতির পরিধিভুক্ত বিধায়, সমাজের সর্বস্তরের জনগণের নিকট এর গুরুত্ব রয়েছে। নিচে অর্থনীতি পাঠের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা কর হলো:
১। মানুষের দৈনন্দিন জীবনে: বিভিন্ন অর্থনৈতিক সমস্যা মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করে। অর্থাৎ, দৈনন্দিন জীবনে মানুষ সসীম সম্পদ ও অসীম অভাবের সম্মুখীন হয়। অর্থনীতির জ্ঞান থেকে মানুষ এসব সমস্যার সমাধান খুঁজে পায়।
২। সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার: মানুষের অভাবমোচনের উদ্দেশ্যে কীভাবে সম্পদ বৃদ্ধি করা যায় এবং কীভাবে সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার সম্ভব তা অর্থনীতির জ্ঞান থেকে জানা যায়। অর্থাৎ, সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষের কল্যাণসাধনই অর্থনীতির মূল লক্ষ্য।
৩। বুদ্ধিমত্তার প্রসার ঘটায়: অর্থনীতি পাঠের ফলে মানুষের চিন্তা ও বুদ্ধিমত্তার বিকাশ ঘটে। অর্থনৈতিক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা একজন মানুষকে যুক্তিবাদী ও বস্তুনিষ্ঠ করে তোলে। অধ্যাপক রবার্টসন তাই যথার্থই বলেছেন- “অর্থনীতি পাঠের ফলে বিচার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।”
৪। শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের নিকট: শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের সর্বদাই ভবিষ্যৎ সম্পর্কে পূর্বাভাস প্রণয়ন করে বাবসায় ও উৎপাদন কার্য পরিচালনা করতে হয়। বাজারে দ্রব্যের চাহিদার গতি-প্রকৃতি অনুধাবন, দেশের ব্যাংক ব্যবস্থা, মুদ্রা বাজার, শেয়ার বাজার, বৈদেশিক লেনদেন ইত্যাদি সম্পর্কে শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের বিশেষ জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। অর্থনীতি পাঠের মাধ্যমে এ সম্পর্কে সার্বিক জ্ঞান লাভ করা যায়।
৫। সমাজকর্মীদের নিকট: দেশের অধিকাংশ সামাজিক সমস্যা অর্থনীতির সাথে সম্পর্কযুক্ত। বেকারত্ব, দারিদ্র্য, নিরক্ষরতাসহ বিভিন্ন সামাজিক সমস্যার সমাধান করতে হলে অর্থনীতির জ্ঞান থাকা বিশেষ প্রয়োজন। তাই সমাজকর্মীদের নিকট অর্থনীতি পাঠের গুরুত্ব অপরিসীম।
৬। শ্রমিক নেতাদের নিকট: শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন গঠন এবং শ্রমিকদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন ও আন্দোলন পরিচালনার ক্ষেত্রে শ্রমিক নেতাদের অবশ্যই অর্থনীতি সম্পর্কে জ্ঞান থাকতে হবে। কারণ দেশের অর্থনীতির সাথে শ্রমিক আন্দোলনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।
৭। রাজনীতিবিদদের নিকট অর্থনীতির সাথে রাজনীতির নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান। অর্থনৈতিক জ্ঞান ছাড়া কোনো রাজনীতিবিদের পক্ষে রাজনীতিতে সফলতা অর্জন সম্ভব নয়। কারণ একজন রাজনীতিবিদের অবশ্যই দেশের রাজস্ব নীতি, মুদ্রা নীতি, বাণিজ্য নীতি, ঋণ নীতি ইত্যাদি সম্পর্কে জ্ঞান থাকতে হবে। সুতরাং, রাজনীতিবিদদের অর্থনীতি পাঠ একান্ত প্রয়োজন।
৮। সরকারি প্রশাসনে সরকারি প্রশাসনে নিয়োজিত বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অর্থনৈতিক জ্ঞান প্রয়োজন। করারোপ, ঋণ গ্রহণ ও পরিশোধ নীতি, মুদ্রাস্ফীতির কারণ ও ফলাফল, বাজেট প্রণয়ন পদ্ধতি ইত্যাদি সম্পর্কে সরকারি কর্মকর্তাদের জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। অর্থনীতি পাঠের মাধ্যমে তারা এ জ্ঞান অর্জন করতে পারে।
৯। মিতব্যয়িতার ক্ষেত্রে অর্থনীতি মানুষকে কৃপণ হতে নিষেধ করে কিন্তু মিতব্যয়িতা শিক্ষা দেয়। মানুষের অভাব অসীম কিন্তু সম্পদ সসীম। এই সীমিত সম্পদের সাহায্যে সীমাহীন অভাবপূরণের জন্য মানুষকে মিতব্যয়ী হওয়া প্রয়োজন। অর্থনীতি পাঠের মাধ্যমে মানুষ মিতব্যয়িতা শিক্ষা করতে পারে।
১০। পরিকল্পনা প্রণয়নে জাতীয় জীবনে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা একান্ত অপরিহার্য। কোন দ্রব্য কী পরিমাণ উৎপাদন হবে, কীভাবে উৎপাদন ও বণ্টন হবে ইত্যাদি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সামনে রেখে পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হয়। সুতরাং, অর্থনৈতিক সমস্যা চিহ্নিতকরণ ও সমাধানকল্পে সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হয়। তাই অর্থনৈতিক জ্ঞানের প্রয়োজন রয়েছে।
১১। উৎপাদন ক্ষেত্রে: দেশের বিভিন্ন খাতে উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য অর্থনীতির জ্ঞান খুবই প্রয়োজন। দেশের সকল উপকরণ ব্যবহার করে কোন কোন দ্রব্যসামগ্রী কী পরিমাণ উৎপাদন করা হবে, কীভাবে উৎপাদন করা হবে, সর্বোপরি, কী কী দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদন করা হবে তা অর্থনীতি চর্চার মাধ্যমেই জানা যায়।
১২। অর্থনৈতিক উন্নয়ন: উন্নয়নশীল দেশের দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন অর্থনীতি পাঠ করা। উন্নয়নশীল দেশের জনগণের ক্ষুধা, দারিদ্র্য, বেকারত্ব, ঋণভার, নিরক্ষরতা দূরীকরণ এবং স্বাস্থ্য সেবা বৃদ্ধিসহ নানান সমস্যা সমাধানের জন্য প্রয়োজন অর্থনীতির জ্ঞান।
উপরোক্ত ” অর্থনীতি পাঠের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা কর ” নামক আর্টিকেল থেকে বলতে পারি যে, শুধু জ্ঞান লাভের জন্য নয় বরং বাস্তব জীবনের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্যও অর্থনীতি অধ্যয়ন প্রয়োজন। মোটকথা, মানুষের দৈনন্দিন জীবনে ও রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে এবং দেশের বিভিন্ন আর্থসামাজিক সমস্যা সমাধানে অর্থনীতি পাঠের গুরুত্ব অপরিসীম। অর্থনীতিবিদ বারবারা উটন তাই যথার্থই বলেছেন, “বাস্তব বিচারে তোমাকে নাগরিক হতে হলে অবশ্যই কোনো না কোনোভাবে অর্থনীতিবিদও হতে হবে।”