বর্তমান সমাজে অধিকাংশ সমস্যায় অর্থনৈতিক সমস্যা । আর এ সকল সমস্যার সমাধান পাওয়া যায় অর্থনীতিতে । তাই আমরা আজকে অর্থনীতি কাকে বলে ? এই টপিক নিয়ে আলচনা করবো । এই আর্টিকেলটি পুরোটা পড়লে অর্থনীতি কাকে বলে তা ভালো করে জানতে পারবেন কারণ অর্থনীতির আওতা ব্যাপক । তাই চলুন বেশি আলোচনা না বাড়িয়ে দেখে নেই অর্থনীতি কী / অর্থনীতি কাকে বলে ? ও এল রবিন্স এর অর্থনীতির সংজ্ঞা সহ সমালোচনা ।
অর্থনীতি কী ?
অর্থনীতির ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘Economics’ গ্রিক শব্দ ‘Oikonomia’ হতে উদ্ভূত হয়েছে। যার অর্থ হলো গার্হস্থ্য পরিচালনা। গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল অর্থনীতিকে “গার্হস্থ্য বিষয় সম্পত্তির ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত বিজ্ঞান” বলে অভিহিত করেছেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে এডাম স্মিথ, রিকার্ডো, মিল প্রমুখ ক্ল্যাসিক্যাল অর্থনীতিবিদ অর্থনীতিকে সম্পদের বিজ্ঞান বলে অভিহিত করেন।
অর্থনীতি কাকে বলে ?
মানুষের অসীম অভাব এবং বিকল্প ব্যবহারযোগ্য সীমিত সম্পদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করাকেই অর্থনীতি বলে ।
বিভিন্ন মনীষীদের সংজ্ঞাঃ
এডাম স্মিথ তাঁর ‘Wealth of Nations’ গ্রন্থে বলেন, “অর্থনীতি হলো এমন একটি বিজ্ঞান যা জাতিসমূহের সম্পদের প্রকৃতি ও কারণ অনুসন্ধান করে।”
অধ্যাপক মার্শাল বলেন, “অর্থনীতি মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ কার্যাবলি পর্যালোচনা করে।” (Economics is the study of mankind in the ordinary business of life.)
এল রবিন্সের মতে, “অর্থনীতি এমন একটি বিজ্ঞান যা মানুষের অসীম অভাব এবং বিকল্প ব্যবহারযোগ্য সীমিত সম্পদের মধ্যে সম্পর্ক বিষয়ক মানব আচরণ সম্বন্ধে আলোচনা করে।” (Economics is a science which studies human behavior as a relationship between ends and scarce means which have alternative uses.)
অর্থনীতি এমন একটি পরিবর্তনশীল সামাজিক বিজ্ঞান যা মানুষের অসীম অভাব এবং বিকল্প ব্যবহারযোগ্য সীমিত সম্পদের মধ্যে সমন্বয় সাধনকারী কার্যাবলি পর্যালোচনা করে।
এল রবিন্স এর অর্থনীতির সংজ্ঞা সমালোচনাসহ বিস্তারিত আলোচনা কর।
ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত অধ্যাপক এল রবিন্স ১৯৩১ সালে তাঁর প্রকাশিত “An Essay on the Nature and Significance of Economic Science” নামক গ্রন্থে অর্থনীতির একটি বিজ্ঞানসম্মত ও সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা প্রদান করেন।
এল রবিন্স এর অর্থনীতির সংজ্ঞা :
“অর্থনীতি হলো এমন একটি বিজ্ঞান যা মানুষের অসীম অভাব এবং বিকল্প ব্যবহারযোগ্য দুষ্প্রাপ্য উপকরণসমূহের মধ্যে সমন্বয় সাধনকারী কার্যাবলি আলোচনা করে।” (“Economics is a science which studies human behavior as a relationship between ends and scarce means which have alternative uses.”)
এল রবিন্স এর অর্থনীতির সংজ্ঞা টি পর্যালোচনা করলে নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলো পরিলক্ষিত হয়:
১। অসীম অভাব: মানুষের অভাব অসীম এবং এ অভাবের প্রকৃতি ও পরিমাণ বিভিন্ন। মানুষের একটি অভাবপূরণ হলে আবার অসংখ্য নতুন অভাব দেখা দেয়। অভাবের এ অসীমতার কারণে মানুষের অর্থনৈতিক কার্যাবলি বিরামহীন চক্রে আবর্তিত হয়ে পড়ে।
২। সসীম সম্পদ: অভাবপূরণকারী সম্পদ ও সময় খুবই সীমিত। সম্পদের সীমাবদ্ধ যোগান এবং স্বল্পতার কারণেই অর্থনৈতিক কাজকর্মের প্রয়োজন হয়। যদি চাহিদার তুলনায় সম্পদের যোগান বেশি হতো তবে মানুষের কোনো অর্থনৈতিক সমস্যা থাকত না।
৩। সমন্বয়সাধন: অসীম অভাবকে কীভাবে সীমিত সম্পদ দ্বারা সমন্বয়সাধন করা যায়, তা অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সীমিত সম্পদ দ্বারা একই সময়ে প্রয়োজনীয় সব অভাবপূরণ করা সম্ভব নয়। তাই সম্পদ অনুযায়ী কোন কোন অভাব কী পরিমাণে পূরণ করা সম্ভব, তা নির্ধারণ করতে হয়।
৪। সম্পদের বিকল্প ব্যবহার: সম্পদের যোগান সীমিত বলে একই সম্পদ দ্বারা আমাদের বিভিন্ন অভাবপূরণের চেষ্টা করতে হয়। তবে নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদ একই সময়ে একাধিক অভাবপূরণে ব্যবহৃত হয় না। যেমন- একখণ্ড জমিতে ধানের বিকল্প পাট অথবা পাটের বিকল্প আখ চাষ করতে পারি।
৫। অভাবের আপেক্ষিক গুরুত্ব নির্ণয় সীমিত সম্পদ দ্বারা প্রয়োজনীয় সব অভাবপূরণ করা সম্ভবপর নয়। তাই অভাবের তীব্রভার ভিত্তিতে সীমিত আয় দ্বারা প্রথমে অত্যাবশ্যকীয়, পরে আরামপ্রদ এবং সর্বশেষে বিলাসদ্রব্যের চাহিদা পূরণ করতে হয়।
এসব কারণে রবিন্সের সংজ্ঞাটি অধিকতর যুক্তিযুক্ত, বিজ্ঞানসম্মত এবং আধুনিক । অধ্যাপক স্টীগলার, সীটভস্কি, এরিখ রোল প্রমুখ অর্থনীতিবিদ অর্থনীতির সংজ্ঞার ক্ষেত্রে রবিনসকে অনুসরণ করেছেন।
সমালোচনা
রবিন্সের সংজ্ঞাটি তুলনামূলকভাবে উৎকৃষ্ট হলেও কেয়ার্নক্রস, বোল্ডিং এবং অধ্যাপক রবার্টসনসহ বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ নিম্নোক্তভাবে এর সমালোচনা করেছেন:
১। বিষয়বস্তুর ব্যাপকতা: রবিন্স অর্থনীতির বিষয়বস্তুকে অত্যন্ত ব্যাপক করেছেন। তার মতে যে সব দ্রব্যের অভাব রয়েছে কিন্তু অভাবপূরণকারী সম্পদ অপ্রচুর এরাও অর্থশাস্ত্রের বিষয়বস্তু। যেমন- মাতৃস্নেহ, পিতৃস্নেহ ইত্যাদি অর্থনীতির বিষয়বস্তু। কিন্তু এদের বিনিময় মূল্য না থাকায় এরা অর্থনীতির আওতাভুক্ত হতে পারে না।
২। নির্বাচন সমস্যা: মানুষ তার ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে অনেক কিছুই পছন্দ বা বাছাই করে থাকে, যাদের সবগুলো অর্থনীতির আওতাভুক্ত নয়। যেমন- একজন লোক সিনেমা হলে না খেলার মাঠে যাবে, এ ধরনের নির্বাচন বা বাছাই অর্থনীতির আওতাভুক্ত হতে পারে না।
৩। কল্যাণ অনুপস্থিত: অধ্যাপক বোল্ডিং-এর মতে, অর্থনৈতিক কাজকর্মের মুখ্য উদ্দেশ্য হলো মানব কল্যাণ। কিন্তু রবিন্সের সংজ্ঞায় এর উল্লেখ নেই। ফলে অর্থনৈতিক কার্যাবলি উদ্দেশ্যহীন হয়ে পড়েছে।
৪। সামাজিক চরিত্রের অনুপস্থিতি: রবিন্সের সংজ্ঞায় অর্থনীতির সামাজিক চরিত্রকে উপেক্ষা করা হয়েছে। স্বল্পতার সমস্যা শুধু ব্যক্তি নয়, সমষ্টির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যেমন- জনস্বাস্থ্য, গণশিক্ষা, সংস্কৃতি ইত্যাদি সামাজিক দিকের প্রতিফলন রবিন্সের সংজ্ঞায় নেই।
৫। উন্নয়ন তত্ত্ব নেই: আধুনিক বিশ্বের অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু রবিন্স তাঁর সংজ্ঞায় উন্নয়নের সমস্যা অন্তর্ভুক্ত করেননি।
৬। মূল্য নিরূপণ তত্ত্বে গণ্ডীভূত: রবিন্স অর্থনীতিকে শুধু মূল্য নিরূপণ তত্ত্বে পরিণত করেছেন। কিন্তু অর্থনীতির অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়; যেমন- জাতীয় আয়, নিয়োগ ব্যবস্থা, বিনিয়োগ ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এ সংজ্ঞায় অনুপস্থিত।
৭। বেকারত্বের ব্যাখ্যা নেই: বর্তমান পৃথিবীর উন্নত ও উন্নয়নশীল উভয় দেশের জন্য বেকারত্ব একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। অনেক দেশেই লক্ষ লক্ষ বেকার জনগোষ্ঠী মানবেতর জীবনযাপন করছে। কিন্তু রবিন্সের সংজ্ঞায় বেকার সমস্যা সংক্রান্ত কোনো আলোচনা নেই।
৮। জটিলতা: রবিন্সের সংজ্ঞা অপেক্ষাকৃত জটিল। সংজ্ঞার বিস্তৃতি দ্বারা রবিন্স অর্থনীতিকে এমন দুরূহ ও জটিল করেছেন যে, সাধারণ মানুষের পক্ষে ইহা বোঝা দুষ্কর।
অর্থনীতিতে কোন তত্ত্বই সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। তাই উপরিউক্ত ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো থাকা সত্ত্বেও সার্বিক বিচারে রবিন্সের সংজ্ঞাটি অধিক যুক্তিযুক্ত, বিজ্ঞানসম্মত এবং উন্নত। এজন্য এ সংজ্ঞাটি অদ্যাবধি অর্থনীতিবিদদের নিকট অধিক জনপ্রিয়।