ব্যষ্টিক অর্থনীতি কাকে বলে ?
ব্যষ্টিক অর্থনীতির আলোচ্য বিষয় ও এর সীমাবন্ধতা
অনেকেই গুগলে সার্চ করেন ব্যষ্টিক অর্থনীতি কাকে বলে , ব্যষ্টিক অর্থনীতির আলোচ্য বিষয় কি কি আবার অনেকে ব্যষ্টিক অর্থনীতির সীমাবদ্ধতা সম্পর্কেও জানতে চান তাই আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় ব্যষ্টিক অর্থনীতি কাকে বলে বা ব্যষ্টিক অর্থনীতি কি ? ব্যষ্টিক অর্থনীতির জনক কে ? এর আলোচ্য বিষয় ও সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে ।
ব্যষ্টিক অর্থনীতি কি ?
ব্যষ্টিক-এর ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো micro। গ্রিক শব্দ ‘mikross’ হতে ইংরেজি micro শব্দের উৎপত্তি। আভিধানিক অর্থে, ব্যষ্টিক শব্দের অর্থ হলো ক্ষুদ্র। ব্যষ্টিক অর্থনীতিতে অর্থনীতির ক্ষুদ্র একটি অংশ নিয়ে আলোচনা করা হয়।
ব্যষ্টিক অর্থনীতি কাকে বলে ?
অর্থনীতির যে শাখায় বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা সম্পর্কে পৃথকভাবে আলোচনা করা হয়, তাকে ব্যষ্টিক অর্থনীতি (Micro Economics) বলে।
অর্থনীতিবিদ Henderson এবং Quandt-এর মতে, “ব্যষ্টিক অর্থনীতি হলো ব্যক্তির এবং সুনির্দিষ্ট ব্যক্তিবর্গের অর্থনৈতিক কার্যকলাপের আলোচনা।”
উদাহরণস্বরূপ, একজন ভোক্তার ব্যক্তিগত আচরণ বিশ্লেষণ, একটি দ্রব্য বা একটি উপাদানের দাম নির্ধারণ, একটি ফার্ম বা শিল্পের ভারসাম্য প্রভৃতি বিষয় ব্যষ্টিক অর্থনীতিতে আলোচনা করা হয়।
অধ্যাপক মরিসডবের-এর মতে, “অর্থনীতির আণুবীক্ষণিক অবলোকন ও বিশ্লেষণকেই বলে ব্যষ্টিক অর্থনীতি।”
অধ্যাপক কে. ই. বোল্ডিং (K. E. Boulding)-এর ভাষায়, “ব্যষ্টিক অর্থনীতি এক একটি ফার্ম, এক একটি পরিবার, প্রতিটি দ্রব্যের দাম, মজুরি, আয়, প্রতিটি শিল্প এবং প্রতিটি দ্রব্য সম্পর্কে পৃথকভাবে আলোচনা করে।”
অর্থনীতিবিদ ও. এম. এমোস (Orley M. Amos)-এর মতে, “ব্যাষ্টিক অর্থনীতি হলো অর্থনীতির একটি শাখা যা অর্থনীতির একটি অংশ আলোচনা করে।”
উপরিউক্ত আলোচনার তে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, অর্থনীতির যে শাখায় বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা সম্পর্কে পৃথক পৃথকভাবে আলোচনা করা হয়, তাকে ব্যষ্টিক অর্থনীতি (Micro Economics) বলে।
ব্যষ্টিক অর্থনীতির জনক কে ?
উত্তর: অধ্যাপক মার্শাল
ব্যষ্টিক অর্থনীতির আলোচ্য বিষয় কি কি ? অথবা,
ব্যষ্টিক অর্থনীতির প্রকৃতি/ পরিধি / আওতা / বিষয়বস্তু আলোচনা কর ।
ব্যষ্টিক অর্থনীতির প্রকৃতি, পরিধি বা বিষয়বস্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনৈতিক কার্যাবলি ভোক্তার আচরণ, বাজার কাঠামো বিশ্লেষণ, দ্রব্য মূল্য ও উপকরণ মূল্যনির্ধারণ এবং উৎপাদন ও সম্পদের কাম্য বণ্টন সংক্রান্ত আলোচনা ব্যষ্টিক অর্থনীতির পরিধি বা বিষয়বস্তু অন্তর্ভুক্ত। নিম্নে সংক্ষেপে ব্যষ্টিক অর্থনীতির পরিধি বা বিষয়বস্তু আলোচনা করা হলো:
১। বাজার কাঠামো বিশ্লেষণ: বাজার কাঠামো বিশ্লেষণ ব্যষ্টিক অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে বাজারকে মূলত, দুভাগে ভাগ করা যায়। যথা- পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজার এবং অপূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজার। অপূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজারকে আবার একচেটিয়া কারবার, প্রতিযোগিতামূলক একচেটিয়া কারবার, অলিগোপলি, ডুয়োপলি ইত্যাদি ভাগে ভাগ করা যায়। এ সকল বাজার কাঠামো পর্যালোচনা তথা, বিশ্লেষণ ব্যষ্টিক অর্থনীতির আওতাভুক্ত।
২। কল্যাণমূলক অর্থনীতি বর্তমানে পৃথিবীতে সকল রাষ্ট্রই মূলত, কল্যাণমূলক রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সরকার জনসাধারণকে সর্বোচ্চ কল্যাণ দেবার চেষ্টা করে। তাই দেশের সকল সম্পদ এবং উৎপাদিত দ্রব্যের কাম্য বণ্টনের মাধ্যমে কীভাবে সামাজিক কল্যাণ সর্বোচ্চ হয়, তা পর্যালোচনা করা ব্যষ্টিক অর্থনীতির বিষয়বস্তুর অন্তর্গত।
আরও পড়ুন>>> অর্থনীতির বিষয়বস্তু আলোচনা কর
৩। ভোক্তার আচরণের প্রকৃতি ব্যাখ্যা: একজন ভোক্তা চায় সর্বদা তার উপযোগ সর্বোচ্চ করতে। ভোক্তার বাজেট সীমিত কিন্তু তার অভাব অসীম। সুতরাং, ভোক্তা তার সীমাবদ্ধ বাজেট দ্বারা কী পরিমাণ দ্রব্যসামগ্রী ক্রয় করে উপযোগ সর্বোচ্চ করবে, এটাই ভোক্তার আচরণ। এই ভোক্তার ভারসাম্য তথা, ভোক্তার আচরণ ব্যাখ্যা ব্যষ্টিক অর্থনীতির আওতাভুক্ত।
৪। দ্রব্য মূল্যনির্ধারণ: দ্রব্য মূল্যনির্ধারণ অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ব্যষ্টিক অর্থনীতি বাজার অর্থনীতির আলোকে চাহিদা ও যোগানের পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে কীভাবে ভারসাম্য দাম ও দ্রব্যের পরিমাণ নির্ধারিত হয় তা আলোচনা করে। সুতরাং, দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি ব্যষ্টিক অর্থনীতির আওতাভুক্ত।
৫। অর্থনৈতিক কার্যক্রম ব্যাখ্যা: ব্যষ্টিক অর্থনীতি-অর্থনৈতিক কার্যক্রমকে বুঝতে সহায়তা করে। ব্যষ্টিক অর্থনীতি বাজার অর্থনীতির আলোকে মৌলিক অর্থনৈতিক সমস্যা, অর্থাৎ কী উৎপাদন করা হবে, কীভাবে উৎপাদন করা হবে, কার জন্য উৎপাদন করা হবে, কীভাবে বণ্টন করা হবে এসব প্রশ্নের সমাধানের চেষ্টা করে। মৌলিক অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান প্রক্রিয়া ব্যষ্টিক অর্থনীতির অন্যতম বিষয়বস্তু।
৬। উপকরণ দাম নির্ধারণ: উৎপাদনের উপকরণগুলো যার যার অবদান অনুযায়ী পারিশ্রমিক পেয়ে থাকে। উৎপাদনের চারটি উপাদান হলো- যথাক্রমে (ক) ভূমি, (খ) শ্রম, (গ) মূলধন এবং (ঘ) সংগঠক। এই উপাদানগুলোর দাম বা পারিশ্রমিক হলো খাজনা, মজুরি, সুদ এবং মুনাফা। সুতরাং, এ সকল উপাদনের পারিশ্রমিক কীভাবে নির্ধারিত হয় তা ব্যষ্টিক অর্থনীতির বিষয়বস্তুর অন্তর্ভুক্ত।
৭। উৎপাদন তত্ত্ব বিশ্লেষণ: উৎপাদন তত্ত্ব অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একজন উৎপাদকের মূল লক্ষ্য হলো মুনাফা সর্বোচ্চ করা। মুনাফা সর্বোচ্চকরণ দুভাবে করা যায়। নির্দিষ্ট পরিমাণ খরচের মধ্য থেকে উৎপাদন সর্বোচ্চ করা অথবা নির্দিষ্ট পরিমাণ উৎপাদনের মধ্য থেকে খরচ সর্বনিম্ন করা। সুতরাং, মুনাফা সর্বোচ্চকরণ তথা উৎপাদকের ভারসাম্যাবস্থা বিশ্লেষণ ব্যষ্টিক অর্থনীতির আওতাভুক্ত।
৮। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য: আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গতি-প্রকৃতি ব্যাখ্যায় ব্যষ্টিক অর্থনীতি সহায়তা করে। এছাড়া বাণিজ্য থেকে লাভ পরিমাপ, বিনিময় হার নির্ধারণ, লেনদেন ভারসাম্য ব্যাখ্যা ইত্যাদি ক্ষেত্রেও ব্যষ্টিক অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
আরও পড়ুন>>> অর্থনীতি পাঠের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা কর ।
ব্যষ্টিক অর্থনীতির সীমাবদ্ধতা
ব্যষ্টিক অর্থনীতির মূল সীমাবদ্ধতাগুলো নিম্নে ব্যাখ্যা করা হলো:
১। অনুমিত শর্ত: ব্যষ্টিক অর্থনীতির প্রতিটি তত্ত্বই বিভিন্ন অনুমিত শর্তের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। এসব অনুমিত শর্তের পরিবর্তন হলে ব্যষ্টিক অর্থনীতির তত্ত্বসমূহ বাতিল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ২। সামাজিক দিক উপেক্ষিত ব্যষ্টিক অর্থনীতিতে অর্থনৈতিক সামাজিক দিক উপেক্ষিত হয়। কারণ এখানে অর্থনীতির বিভিন্ন তত্ত্ব পৃথক ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে ভাগ করে আলোচনা করা হয়।
৩। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ব্যষ্টিক অর্থনীতির অধিকাংশ তত্ত্ব ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ (Laissez faire) আদর্শের সাথে সামঞ্জস্য রেখেপ্রণীত হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে কোনো দেশের অর্থনীতিতে এরূপ বিশুদ্ধ আদর্শভিত্তিক বক্তব্য দেখা যায় না।
৪। পূর্ণ নিয়োগ: ব্যষ্টিক অর্থনীতির অধিকাংশ তত্ত্ব পূর্ণ নিয়োগ ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু পূর্ণ নিয়োগ সম্পর্কিত ধারণাটি আজকের পৃথিবীতে বাস্তবতা বর্জিত।
৫। প্রমাণ করা যায় না: ব্যষ্টিক অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাম্যতা, দক্ষতা, সর্বোচ্চকরণ ও সর্বনিম্নকরণের শর্তাবলির ক্ষেত্রে যে সব বিষয় আলোচনা করা হয়েছে, তা বাস্তব তথ্য দ্বারা প্রমাণ করা যায় না।
৬। আংশিক চিত্র: ব্যষ্টিক অর্থনীতি দ্বারা একটি দেশের অর্থনীতির আংশিক চিত্র পাওয়া যায় কিন্তু সামগ্রিক বা পূর্ণ চিত্র পাওয়া যায় না।
৭। বাস্তবতাবর্জিত: ব্যষ্টিক অর্থনীতিতে কোনো কোনো সময় বিভিন্ন ব্যষ্টিক চলকে পারস্পরিক সম্পর্ক ব্যাখ্যা করার সময় “অন্যান্য অবস্থা স্থির” ধরে নেওয়া হয়। যা প্রকৃতপক্ষে বাস্তবতা বর্জিত। সংক্ষেপে এগুলোই ব্যষ্টিক অর্থনীতির সীমাবদ্ধতা।